মধ্যপ্রাচ্যে বর্জ্যহীন কোরবানি ঈদ

ফাতেমা আবেদীন

ঢাকা শহরের অলি গলি নয় ভিআইপি সড়কসহ বড় বড় রাজপথে পা রাখলেই বোঝা যাচ্ছে ঈদ-উল আজহা প্রায় সমাগত। প্রত্যেকের সঙ্গে গরু, নয়তো খড় বিচালি, নতুবা চাটাই, হোগলা। এগুলো না থাকলে ছুরি, বটি, কাচি বা কাঠের গুড়িসহ লোকের দেখা অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর এসবও যদি না থাকে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা গোবর আর গরু-ছাগলের মূত্রের দুর্গন্ধ আপনাকে নিশ্চিত জানাবে ‘ঈদ মোবারক’।

ঈদের দিন গরুর গোবর আর মূত্রের যন্ত্রণা কমে আসলেও কোরবানি পরবর্তী বর্জ্যের ঘনঘটা। কমপক্ষে ১৫ দিন এই তিলোত্তমা নগরীর অপরিচ্ছন্নতা আপনাকে ভুলতে দিবে না কোরবানি ঈদ এসেছিল। ২০১২ সালে ঈদের আগের দিন এক আত্মীয় মারা যান। ঈদের দিন তাদের বাসায় খাবার দিতে যাব বলে বের হয়েছি। রাস্তার তাবৎ রক্ত, গোবর ও অন্যান্য বর্জ্য ঠেলে লাফ দিয়ে সিএনজি চালিত অটোতে উঠে তিন লাফ দিয়ে নেমে এলাম। পুরো অটো রক্তাক্ত। রক্তের গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া দুস্কর হয়ে উঠেছে। অটোটাকে বাড়ি পর্যন্ত এনে আগে ভালো করে পানি দিয়ে নিজেই ধুয়ে দিলাম এর পর খাবারের হাড়ি-পাতিল নিয়ে উঠলাম। কিন্তু পথের মধ্যে সার্বিক দুর্গন্ধের ঘনঘটা বেশ ভালোই পোহাতে হয়েছিল।sheep qurbani in jeddah

কর্মসূত্রে দীর্ঘ পাঁচ বছর দেশের বাইরে সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দাহতে কাটাতে হয়েছিল। সেখানে পাঁচটি কোরবানির ঈদ উদযাপনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আদ্যোপান্ত মুসলমান দেশ হলেও কোরবানি নিয়ে আমাদের মতো আদিখ্যেতা বা বাড়াবাড়ি কোনওটাই সেখানে দেখিনি। সৌদি আরবের দেড় কোটি মুসলমানের দেশে অন্তত ৭০ লাখ কোরবানি হয়। এর মধ্যে ৩০ লাখ কোরবানি হয় হজের মাঠে। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয় মীনা, আরাফাত মুজদালিফা এই তিন অঞ্চলে। মক্কা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এই অঞ্চলের আনুমানিক এলাকা ৪০ মাইল। ৪০ মাইল এলাকায় ৩০ লাখ পশু কুরবানি হলেও এক ফোটা রক্ত বা গোবরের দেখা মেলেনি। কিংবা দুর্গন্ধও পাওয়া যায়নি।

এজন্য অবশ্য সৌদি সরকার ও ইসলামিক ডেভেলোপমেন্ট ব্যাংক তথা আইডিবিকে পুরো কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। মক্কা ও মীনার মাঝখানে ফাঁকা স্থানে পশু পালনক্ষেত্রে ও কসাই খানার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। কোরবানি দিতে ইচ্ছুক হাজীদের জন্য রয়েছে টিকেটিং ব্যবস্থা। আপনি টিকেট কেটে একটা টোকেন নিবেন সে সময় আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময় বলে দেওয়া হবে। যেহেতু কোরবানি শেষ হওয়ার পর হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় সেই সময়ের মধ্যে পশুটি কুরবানি হয়ে যাবে বলে নিশ্চিত করা হয়। পশুটি কোথায় কিভাবে কোরবানি হয় সেটি দেখা বা একটুকরো মাংস খাওয়ার সুযোগটি হাজীদের জন্য রাখা হয় না। এতে অরাজকতা হবে বলেই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া হয়। পরে সেই মাংসগুলো সংরক্ষণ করে সারা বিশ্বের গরীব মুসলিম দেশগুলোতে বণ্টনের দায়িত্বটি আইডিবি পালন করে থাকে। তবে একেবারে যে কোরবানি দেওয়ার ঘটনা ঘটে না এমন নয়। অতি উৎসাহী বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানীরা চেষ্টা করেন নিজেরা আশে পাশের কোনও গ্রামের ফার্ম থেকে ছাগল কিনে কেটে কুটে কোরবানি দেওয়ার। যেহেতু কোরবানির চেয়ে হজের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ থাকে তাই এই সংখ্যাটি একেবারেই সামান্য। সেক্ষেত্রে বর্জ্য এমন স্থানে ফেলা হয় যেখান থেকে কোনও সংক্রমনের সুযোগ থাকে না। যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলার কারণে গ্রেফতার হওয়ারও অনেক ঘটনা রয়েছে।

এতো গেলো হজের মাঠের কথা। শহরেও কোনওদিন কোরবানি নিয়ে আদিখ্যেতা দেখা যায়নি। নির্দিষ্ট স্থানে কসাই খানা আছে। সেখানে গিয়ে টাকা দিয়ে পশু পছন্দ করে দিয়ে আসতে হয়। এর পর কসাই মাংস কেটে রেডি করে খবর দিবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গরুর বট থেকে শুরু করে সিনার হার কিংবা নলি কোনওটাই বাদ পড়বে না। সব কিছুই রেডি থাকে। কসাই কোথায় ময়লা ফেলবে বা কি করবে সেই দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। বাড়ির সামনে গরুর বাধার স্টাইল এখানে একেবারেই নিষিদ্ধ।

২০১০ সালে একবার জেদ্দাহর বাঙ্গালী কমিউনিটির বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় প্রকাশ্যে পশু কোরবানির জন্য। একেবারে সরাসরি রাস্তায় কেউই গরু জবাই করেননি। কিন্তু বিষয় হচ্ছে বাড়ির উঠানে কিংবা গ্যারেজে জবাই করা গরুর রক্ত গড়িয়ে পথের মধ্যে চলে এসেছিল। আর যায় কোথায়, গরুর মাংসসহ দা বটি সব বাজেয়াপ্তও করেছিল সিটি করপোরেশন পুলিশ। তাই শখ পূরণের জন্য নিজের হাতে কুরবানি করতে চাইলে সেটা নিজ দায়িত্বে এবং এতোটাই গোপনে করতে হবে যে কেউ যেনও টেরও না পায়। টের পেলে ঈদের দিন মাংস খাওয়ার পরিবর্তে জেলের ভাত খেতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: nazlagreat@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics