জলবায়ু পরিবর্তনঃ যে ৯ টি কারণে ২০১৮ তে আমরা আশাবাদি হতেই পারি!

সাদিয়া লেনা আলফি

গেল বছরটি ছিলো জলবায়ুর জন্য বেশ আশঙ্কাজনক। বিষয়টি মূলত ঘটেছে বর্তমান বিশ্বের শক্তিধর নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারী ও জীবাশ্ম জ্বালানীধর দেশগুলোর সাথে সখ্যতা তৈরি, পরিচ্ছন্ন শক্তি পরিকল্পনা বাতিল করা ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসা- অর্থাৎ, যে সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে বেশী কাজ করা প্রয়োজন ছিলো সে সময় তিনি এর উন্নতি রোধ করতে যা যা করা সম্ভব তাই করেছেন। নভেম্বরের একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে, কিছুদিন কমতে থাকার পর ২০১৭ সালের পরপর হঠাৎ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তে শুরু করেছে।

যদিও এটি বিশাল আন্দোলনের ছোট একটি অংশ। সারা বছর নানা হতাশাজনক খবরের পর ৯ টি বিষয় আমাদের আশাবাদী করে তুলতেই পারে। এরা শুধুই আলাদা আলাদা কিছু দেশের উদ্যোগ নয়, একসাথে হয়ে এ ছোট উদ্যোগ গুলোই যদি জলবায়ুতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসে খবরের কাগজে হেডলাইন হয়, তাহলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!!

১. জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ব্যাপক ভূমিকা নিচ্ছে চীনঃ

চীন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম কার্বন দূষণকারি এবং গত বছর কয়লা ব্যবহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও চীন তা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছে। শুধুমাত্র এই বছরেই কম্যুনিস্ট সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানীর উপর ৩৬১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা জীবাশ্ম জ্বালানী কেন্দ্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ করবে, প্রায় ১০০ টি কয়লাকেন্দ্র বন্ধ করবে, এবং দূষণ কমানোর জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ আর্থিক বাজার চালু করবে। চীন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে আরো শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হবার একটা পথ হিসেবে দেখছে যা বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুনভাবে গঠিত করতে পারবে।

২. নবায়নযোগ্য জ্বালানী জীবাশ্ম জ্বালানীকে হারিয়ে দিচ্ছেঃ

ট্রাম্প সরকার কয়লা অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানী এখনো পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছে। তার পেছনে খুব সহজ আর্থিক কারণ রয়েছে। সোলার কিংবা বায়ু কেন্দ্রিক জ্বালানীগুলো খুব সস্তা হয়ে পড়ছে যে কারণে ২০১৬ সালে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যুতই উৎপাদিত হয়েছে নবায়নযোগ্য উপায়ে। আন্তর্জাতিক সংস্থা Industry tracker REN21 এর প্রকাশিত জুনের রিপোর্ট অনুযায়ী জ্বালানীর দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে আর্জেন্টিনা, ভারত, ডেনমার্ক সহ বেশ কয়েকটি দেশে। এমনকি আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা, যারা নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে পূর্বে অবমূল্যায়ন করতো, এমন কি তারাও অক্টোবরে বলেছে, ”আমরা নতুন এক সময়ের সূচনা দেখতে পাচ্ছি”।

৩.নবায়নযোগ্য জ্বালানী এর উপর ট্যাক্স নয়ঃ

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে রিপাব্লিকান পার্টির অস্বীকৃতি সত্ত্বেও এখানে মজার বিষয় রয়েছে। এটি নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে অস্বীকার করছে না। টেক্সাস, আইওয়া এবং ক্যানসাসের মত রেড স্টেটগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি অনেক কর্মসংসস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। সুতরাং অধিবেশনে রিপাবলিকান ও সিনেট সদস্যরা যখন ফেডারেল সরকারের জন্য ট্যাক্স বিল কমানোর প্রস্তাব করেন যা বায়ু, সৌরশক্তি ও ইলেক্ট্রিক গাড়িকে সমর্থন করে কিছু রিপাবলিকান কংগ্রেসের সদস্য তাতে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ফাইনাল বিল, যা প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার যুক্ত করার কথা ছিলো, এটি মূলত ডেমোক্র্যাট ও রিপাব্লিকান সমর্থনের সাথে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর জন্য বেশ ভালো পরিমাণে অর্থ সঞ্চয় করে রাখবে।

৪. জীবাশ্ম জ্বালানী নিয়ন্ত্রিত গাড়ীর সময় শেষ হতে চলেছেঃ

বর্তমানে রাস্তায় চলাচলকারী বেশীরভাগ গাড়ী গ্যাস ও ডিজেল দিয়ে চলে। ২০১৭ সালের বেশ কিছু ঘটনা থেকে বোঝা যায় এই দৃশ্য পরিবর্তন হতে চলেছে। শুধু ভলভো ঘোষিত ২০১৯ সালের মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও হাইব্রিড গাড়ি বিক্রির পরিকল্পনা নয়, বা চীনের মত গ্যাস চালিত গাড়ি নয়, বরং সমস্ত গাড়ী ব্যাবসায়ীদের মধ্যে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। প্রাইভেটগাড়ি থেকে পরিবর্তিত হয়ে মোবাইল নিয়ন্ত্রিত রোবটের পা দ্বারা চালিত ইলেক্টিক গাড়ির সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। Automotive News এর একটি রিপোর্টে এ General Motor Bob Lutz এর সাবেক চেয়ারম্যান বলেন”আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তবুও আমরা অটোমোটিভ সময়ের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি”।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সমর্থনকারিরা নির্বাচিত হচ্ছেনঃ

গেলো বছর যদিও রাজনৈতিক ঘটনাবলি বেশ বৈশ্বিক প্রভাব ফেলেছিলো, এর ইতিবাচক প্রভাবও ছিলো বেশ। প্রথমেই আসে যুক্তরাজ্যের গ্রীষ্মের নির্বাচনের কথা। বেশ কিছু তরুণ ভোটার জেরেমি করবিনের লেবার পার্টিকে জয়ি হতে অভূতপুর্ব সহযোগীতা করেন। এর পরেই আসে স্টেট ও লোকাল ইলেকশনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিজয় লাভের কথা। এর কোন নির্বাচনেই জলবায়ু মুখ্য বিষয় ছিলো না। তবু বেশকিছু বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে আলাবামার ডগ জূন্সের মত অনেকেই বৈশ্বিক উষনতা কমাতে দৃপ্ত ভূমিকা রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

৬. জীবাশ্ম জ্বালানী প্রকল্পে বিনিয়োগ বন্ধ করতে জোর আন্দোলনঃ

২০১৭ সালে বেশ কিছু বিনিয়োগকারীরা উদ্যোগ নেন জীবাশ্ম জ্বালানী বিক্রি বন্ধ করার যদিও তা তেমন নজর কাড়তে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এটি বেশ কিছু দিকে উন্নতি নির্দেশ করে। সিয়াটল এবং সান্তা মনিকার মত শহরে  যেখানে Dakota access pipeline নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন চলছে, সেখানে আদিবাসী জনগণ স্থানীয় ব্যঙ্কগুলোকে বাধ্য করেছে Dakota access pipeline এর মতো পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্পে বিনিয়োগ বন্ধ করতে। নরওয়ে তাঁদের সার্বভৌম সম্পদ তহবিলে ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করছে জ্বালানী তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানীতে বিনিয়োগের জন্য।

৭. জলবায়ু পরিবর্তন জনিত মামলা বাড়ছেঃ

সরকার বা কোম্পানীগুলোকে জলবায়ুর ক্ষতি করার জন্য আদালতে অভিযুক্ত করানোটা কঠিন। ফেডারেল নেতারা পদক্ষেপ না নেয়ায় সাধারন মানুষই তা করছে। ইউনাইটেড নেশন্স এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি গবেষনা করে দেখিয়েছে ২০১৪ সাল থেকে জলবায়ু সংক্রান্ত মামলা বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে ৬৫৪ টি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এমন জবাবদিহিমূলক এবং নাগরিক বান্ধব আন্দোলন সত্যি আশা জাগায় বৈকি।

৮. রাজ্য এবং শহরগুলো এগিয়ে আসছেঃ

ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর জেরি ব্রাওন যখন চীনে একটি এনার্জী কনফারেন্সে যান, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সাথে ঘনিষ্ঠ আলোচনায় বসেন। এই বৈঠক মোটামুটি ২০১৭ সালের মার্কিন জলবায়ু নীতির মুখে ছাই লাগানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। যেখানে ট্রাম্প সরকার সরাসরি জলবায়ু প্রস্তাবকে নাকচ করে দিচ্ছেন সেখানে ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্যগুলো এগিয়ে আসছে। রাজ্য এবং শহরের কর্মকান্ডগুলো যদিও রাষ্ট্রের নীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না তবুও ক্যালিফোর্নিয়ার মত রাজ্যগুলোর পদক্ষেপের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তির ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক এগিয়ে গিয়েছে।

৯. খনিজ তেল কোম্পানী গুলোর ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখেঃ

রয়াল ডাচ শেল কোম্পানীর প্রধান নির্বাহী জুলাইতে একটি অসাধারণ ভবিষ্যৎবানী করেছেন, আগামি দশ বছরে বৈশ্বিক তেলের চাহিদা প্রথমে বেশ তুঙ্গে থেকে এরপর কমে যেতে পারে, Statoil ও একই ধরনের আশঙ্কা করছে। এটি নিসন্দেহে এই শিল্পকে প্রশ্নের মুখে ফেলে যাদের উন্নতি নির্ভর করে তাদের ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির উপর। অন্যান্য কোম্পানী যেমন Chevron যদিও জনসম্মুখে উচ্চ তেলের চাহিদার বিষয়টি নাকচ করে দিচ্ছে, বড় তেল কোম্পানীর নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমাগতই সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। ট্রাম্পের আমলের পুর্বে তেল ব্যবসাকে এতোটা জনপ্রিয় হতে দেখা যায়নি তবে এর দিন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে।

আসুন তবে, ২০১৮ নিয়ে নতুন কিছু স্বপ্ন আমরাও দেখি। বায়ু-শব্দ দূষণে নাকাল ঢাকাবাসী বছরের প্রথম দিনটি উদযাপন করুন নির্মলতায় আর প্রশান্তিতে। এই কামনায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics