দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহের বিপদ

তাহলে কি ২০১৭ সালেই জানা গেছিলো ২০২৪ এ এমন অসহনীয় তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া?

এনভায়রনমেন্ট-মুভ ডেস্ক

চলমান তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত, হিট স্ট্রোকে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। আমরা এখন আলোচনা করছি, বেশী করে গাছ লাগালে, বা আরো বেশী পরিবেশ বান্ধব শহর গড়ে তুলতে পারলে আমরা আগামী দিনগুলোতে এই তাপপ্রবাহ থেকে নিস্তার পেতে পারি, আসলেই কি তাই?


২০১৭ সালে দি হংকং ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলিজি, লোয়োলা ইউনিভার্সিটি ম্যারিমাউন্ট লসএঞ্জেলস, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষকদল জলবায়ু মডেলিংকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি ভয়াবহ ভবিষ্যৎবাণী প্রকাশ করেন, যেখানে তাঁরা চরম তাপপ্রবাহের উপর ভবিষ্যদ্বাণী করেন যা মানুষের বেঁচে থাকার থ্রেশহোল্ড বা প্রান্তীয় মাত্রা অতিক্রম করতে পারে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি রিজিওনাল ক্লাইমেট মডেল (MRCM) ব্যবহার করে কাপলড মডেল ইন্টারকমপ্যারিসন প্রজেক্ট ফেজ ৫ (CMIP5) থেকে ডেটার পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্বের সিমুলেশনে অর্থাৎ হিস্টরিক্যাল, RCP4.5 এবং RCP8.5 মাত্রার জন্য ২১০০ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত অনুমান প্রদান করেন।

RCP4.5 গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের একটি স্থিতিশীল দৃশ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন ২০৪০ সালের দিকে সর্বোচ্চ, তারপরে হ্রাস পায়। এটি ২১০০ সালের মধ্যে প্রতি বর্গ মিটারে ৪.৫ ওয়াট শক্তির বিকিরণ নির্দেশ করে। অপরদিকে, RCP8.5 একটি উচ্চমাত্রায় গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন অবস্থা যেখানে নির্গমন ২১ শতক জুড়ে বাড়তেই থাকবে বলে ধরে নেয়া হয়। এটি ২১০০ সালের মধ্যে প্রতি বর্গ মিটারে ৮.৫ ওয়াট শক্তির বিকিরণ নির্দেশ করে।


গবেষণাটি অয়েট-বাল্ব (wet-bulb) তাপমাত্রার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যা কিনা তাপ এবং আর্দ্রতার সমন্বয়ের একটি পরিমাপ যা প্রকৃত অনুভূত (real feel) বাতাসের তাপমাত্রা নির্দেশ করে। মডেলিং মাধ্যমে তাঁরা দেখতে পান, স্বাভাবিক পরিস্থিতি বা বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ২১০০ সালের মধ্যে, গঙ্গা নদী উপত্যকা এবং উত্তর-পূর্ব ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রান্তিক সীমা ছাড়িয়ে অনুভূত হতে পারে, ফলস্বরূপ, এই উচ্চতাপমাত্রা বা তাপপ্রবাহ, মানুষের বেঁচে থাকা প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ ছাড়া অসম্ভব করে তুলতে পারে। খেয়াল করুন, এ গবেষণাটি যখন প্রচালিত হয় সেটি ১৯৭৯ থেকে ২০১৫ এর রেকর্ডকৃত তথ্য নিয়ে কাজ করেছিলো এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদেরকে কিছুটা ধারণা দিয়েছিলো। ২০২৪ সালে যার কিছুটা হয়তো আমরা দেখতে পাচ্ছি সাম্প্রতিক সময়ে এয়ার কন্ডিশনের বিক্রিতে হিরিকে, এয়ার কন্ডিশন ছাড়া যেন ঢাকা শহরে টিকে থাকাই দায়।

তাপপ্রবাহের সম্ভাব্য উথানের পেছনে ৩টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, ১) মৌসুমি বায়ু: উষ্ণ এবং আর্দ্র বায়ু বর্ষাকালে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর থেকে সিন্ধু ও গঙ্গা উপত্যকায় পরিবাহিত হয়, যা ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা বাড়ায়। ২) ভূগোল: দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 100 মিটারের নিচে, যেখানে উচ্চ উচ্চতার তুলনায় বায়ু উষ্ণ হতে থাকে। ৩) সেচ: এই উপত্যকায় ব্যাপক সেচ ভূপৃষ্ঠের শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করে, যার ফলে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু, এল নিনো-লা নিনার মতো কারণগুলি তাপপ্রবাহের তীব্রতা এবং সময়কালকে প্রভাবিত করে, বিলম্বিত বর্ষা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে, বিশেষ করে এল নিনো বছরের পরে। এই উপাদানগুলি অঞ্চলে তাপপ্রবাহের ঝুঁকি এবং তীব্রতা বাড়াতে সম্মেলিতভাবে প্রভাব ফেলছে।


বিশেষ করে, ঘনবসতিপূর্ণ কৃষি অঞ্চল যেমন সিন্ধু এবং গঙ্গা নদীর অববাহিকাগুলিকে চরম তাপ(extreme heat) হটস্পট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিশ্ব জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এতে আরও বলা হয়েছে যে প্রায় ৭৫% জনসংখ্যা প্রায়শই ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রা সহ বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে, যাতে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়, সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহে যার একটি নমুনা আমরা দেখি আগের চেয়ে অনেকবেশি সংখ্যায় হিট স্ট্রোকের ঘটনায়।


তাতপর্যপূর্ণ এ গবেষণাটি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটিতে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং জনস্বাস্থ্যের প্রস্তুতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান হিসাবে কাজ করবে বলে মনে করা হয়েছিলো ফলে, ২০১৭ সালে গবেষণাটি প্রকাশিত হবার পরে এটি বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলোয় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আদৌ কি কোন ফলপ্রসূ উদ্যোগ আমরা দেখতে পেয়েছি? প্রশ্ন থেকেই যায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics