ধানের তুষঃ সম্ভাবনাময় জৈব জ্বালানী

মিথিলা চক্রবর্তী

“Rice Husk “ বা “Rice Hull” এর বাংলা আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ধানের খোসা বা তুষ বা আবর্জনা । এই অর্থগুলোর মধ্যে তৃতীয় অর্থটাই “Rice husk” কে গুরুত্বপূর্ণ করে। ভূমিকায় একে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে ধানের অকিঞ্চিৎকর বহিঃআবরন যার কাজ ধানকে সুরক্ষা প্রদান করা। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে শুধুই নিরাপত্তা বিধান নয় বরং সার হিসেবে, অন্তরন সামগ্রী বা অন্তরক হিসেবে , নির্মাণে বা নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে, জ্বালানী হিসেবে এবং সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে এই আবর্জনাটি ব্যবহার করা যায়। এই উপরোক্ত লাইনগুলো অনেক কিভাবে,কেন এর সৃষ্টি করবে মনের মধ্যে যার উত্তর দেয়ার প্রয়াস এই লিখাটি।

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ ।ধান উৎপাদনে এই দেশের অবস্থান উপরের দিকে। চীন, ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া আর এর পরই বাংলাদেশ। প্রায় ৩৩৮০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদী এই বাংলাদেশ অনেকখানিই পিছিয়ে আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর তালিকায় যেখানে অন্যান্য দেশ অগ্রগতির সূচক পার করছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ আমাদের উদাসীনতা !!! এই আবর্জনাটা এমন কিছু চারিত্রিক ধর্ম বহন করে যা ব্যবহার করে আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি চোখে পড়ার মত। এবার আসুন চোখ বুলাই সেইসব ধর্মগুলোয় ।

ধানের খোসা বা তুষ।
ধানের খোসা বা তুষ।

ধানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই তুষ ( ১০০কেজি ধানে প্রায় ২০ কেজি)। বাকি অংশ ধানের দানা এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যাকে বলে “Rice Bran” বা ধান বা চালের অসার অংশ !!! যা আমাদের তেলের চাহিদা পুরণ করতে পারে।

 ধানের বিভিন্ন অংশের পরিমাপ ( Mansari and Ghali, 1999)
ধানের বিভিন্ন অংশের পরিমাপ ( Mansari and Ghali, 1999)

এই খোসাটি জন্মগতভাবে যে সব চারিত্রিক বিশিষ্টতা নিয়ে এসেছে সেগুলো হলো কিছুটা এরকম , সিলিকা দিয়ে গঠিত কিউটিকল, সেলুলোজ ৪০-৫০%, লিগনিন ২৫-৩০ %, ছাই বা ভস্ম ১৫-২০%, এবং আদ্রতা ৮-১৫%। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অন্য যেকোন গাছ থেকে ধানের ভস্মের পরিমাণ বেশি এবং বিভিন্ন উপাদান বাষ্পীভূত হবার পর এই ভস্মে প্রচুর পরিমাণ সিলিকা থেকে যায়। এই সিলিকাই তুষের বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্ব বাড়াতে দায়ী। বাংলাদেশে চালের মিলগুলোতে এই তুষ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ, ধানকে প্রক্রিয়াকরণের আওতায় এনে চালে রুপান্তর করতে জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। এর ফলে সত্যিকারভাবে সিলিকার তেমন কোন অর্থকরী ব্যবহার হয় না। এমনকি ইটের ভাটাগুলোও এই সিলিকাময় তুষকে ইট তৈরিতে ব্যবহার করে। অথচ সরাসরিই এটি অনেক কাজে লাগে যেমনঃ সক্রিয় কার্বন বা Activated Carbon এর উৎস হিসেবে, সিলিকন যৌগ হিসেবে, xylitol, furfural, ethanol, acetic acid, lingo sulphonic acids তৈরিতে । এমনকি মেটাল বা যন্ত্রাংশ তৈরিতে যেসব সেক্টর ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে পালিশ করতে এবং পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা যায় ইত্যাদি । এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।

energy sector bd
বাংলাদেশে ব্যবহৃত শক্তির রকমফের

ধান এমন একটি অর্থকরী ফসল যা সবচেয়ে বেশি উৎপাদন আর খাওয়া হয় বাংলাদেশে । বিশ্ব খাদ্য সংস্থা FAO ২০১১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর ১৬.৪৮ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে যা ২০১১ তে ৭১৮.৩ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। এটি অন্যদিকে তুষের পরিমাণ বাড়ারও ইঙ্গিত করে। জৈবশক্তি হিসেবে তুষের ব্যবহার যা কিনা আমরা এড়িয়ে চলছি তারই বিজ্ঞানসম্মত প্রতিনিয়ত ব্যবহার আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে করছে স্বয়ংসম্পূর্ণ ।

উপরের চিত্র বা গ্রাফটি দেখাচ্ছে যে চুড়ান্ত বা সবচেয়ে বেশি পরিমাণ শক্তি পাই আমরা ধানের খোসা জ্বালিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা ব্যবহারটা এই শক্তির কোথায় করছি??

যথাক্রমে, ধান অর্ধসিদ্ধ করা তুষের দ্বারা এবং ডিমের আকৃতি বিশিষ্ট কয়লার গুড়ার গুলি বা চাপড়া তৈরি ।
যথাক্রমে, ধান অর্ধসিদ্ধ করা তুষের দ্বারা কয়লার গুড়ার গুলি বা চাপড়া তৈরি ।

এই ছবিগুলো আমাদের তুষের ব্যাবহারটা স্পষ্ট করে। বাংলাদেশে এই দুই রকমের ব্যাবহারই সবচেয়ে বেশি। অথচ University of Virginia’s Darden School Of Business এর দুইজন ছাত্র সম্প্রতি একধরনের ব্যবসা স্থাপন করে যার দ্বারা তারা গ্যাসিফায়িং পদ্ধতির মাধ্যমে ১০,০০০ জনের গ্রামে বিদ্যুৎ সাপ্লাই করে।২টি ধানের মিল থেকে যে husk বা hull আসে তার গ্যাসিফায়িং-ই এদের ব্যবসার উৎস ।নিচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায়গুলো একটি চিত্রে দেখানো হলঃ

 বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায়
বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায়

উপরের এসকল উপায় মোটেও অসম্ভব নয়। এছাড়াও স্থাপত্য শিল্পে এই Husk বা Hull এর ব্যবহার অনস্বীকার্য। RHA (Rice Husk Ash) যা কিনা Husk পোড়ানোর ফলে পাওয়া যায় তা সিলিকন পরিপূর্ণ Pozzolanic material এর চরিত্র দেখায় । RHA কে ব্যবহার করে সিমেন্টের পরিপূরক এবং ইট তৈরিতে কাঁদার পরিবর্তে ব্যবহার সময়ের এবং সৎ ইচ্ছার বিষয় মাত্র। শুধু তাই নয়, তথাকথিতভাবে যেসকল মৃত্তিকাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে হয় এদের উন্নতিকরণে প্রতিবছর আমরা প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম কার্বনেট আমদানি করি । কিন্তু তুষ এই সমস্যারও সমাধান ।

১। RHA (Rice Husk Ash) এর রয়েছে খুবই কার্যক্ষম পৃষ্ঠভাগ।

২। RHA (Rice Husk Ash) এর রয়েছে খুবই বেশি CEC (Cation Exchange Capacity)।

৩। RHA প্রচুর পরিমানে দ্রবীভূত সোডিয়াম , ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম ধরে রাখতে পারে। এমনকি NO3 কেও ধরে রাখার ক্ষমতা অনেক বেশি ।   সুতরাং ভালো Buffering Capacity এর দ্বারা তুষ এর ব্যবহার অম্লতা ক্ষরতা এবং লবনাক্ততা সমস্যা সহজেই মেটাতে পারে।

এছাড়াও লিথিয়াম ব্যাটারী তৈরি, পটাসিয়াম এর পরিবর্তে সার হিসেবে, সিরামিক ফিল্টারে এই ধানের খোসা তথা আবর্জনাটি সহজেই ব্যাবহার করা যায়।

কিন্তু আমরা তুষের ১% ও এসব কাজে ব্যাবহার করিনা । আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি , নীতি নিয়মের গঠন , মনোভাব ,লোন সুবিধা, উৎপাদনের এর জন্য কাঁচামালের অভাব ইত্যাদিকে দায়ী করা যায় আমাদের এই অবহেলার জন্য। অথচ আমরা কখনই ভেবে দেখিনা এই প্রাকৃতিক সম্পদটি ঠিক এভাবে । এমনকি এইসব কাজও সহজেই নতুন ধরনের উদ্ভাবন ক্ষেত্র খুলতে পারে যার মাধ্যমে বেকার সমস্যারও সমাধান করা যায়।

অবশেষে Neil LaBute এর মতে, “We live in a disposable society. It’s easier to throw things out than to fix them. We even give it a name – we call it recycling.” উন্নয়নশীল দেশের মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত হবে এই প্রাকৃতিক সম্পদটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দেশের জন্য, দশের জন্য ব্যাবহার করা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics