সুস্থ মাটি, সুস্থতায় মাটি!

মনিজা মনজুর

মাটি জীবনের আধার। আর সুস্থ মাটি সুস্থ জীবনের আধার। মৃত্তিকা সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত যতগুলো উপাদানের যোগান দিয়ে চলেছে তা হয়তো অন্য কোনো উপাদান দিতে পারেনি।

চলছে আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ। মৃত্তিকা বর্ষের আগস্ট মাসের প্রতিপাদ্য বিষয়, “স্বাস্থ্য রক্ষায় মাটি”। চলুন তাহলে জেনে নিই স্বাস্থ্য রক্ষায়-সুস্থতায় মাটির ভূমিকা কী?

মৃত্তিকার সাথে নোবেল পুরস্কারের একটা সম্পর্ক আছে, জানেন কি? ঠিক আছে একটু বুঝিয়ে বলছি। আমরা জানি, মৃত্তিকা অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীবের আবাসস্থল। এক টেবিল চামচ পরিমান মাটিতে পৃথিবীব্যাপী মানুষের সমান সংখ্যক অনুজীব থাকে। তাহলে আঁচ করে নিন আপনার চারপাশের মাটিতে অনুজীবের সংখ্যাটা কেমন হতে পারে! ভালো-খারাপ উভয় ধরণের অনুজীবই মাটিতে পাওয়া যায়। অ্যানথ্রাক্স, সালমোনেলা ধরণের ক্ষতিকর অনুজীবগুলোকে মেরে ফেলার জন্য অসংখ্য উপকারি অনুজীব আছে। এরা এদের দেহ থেকে এক ধরনের এন্টিমাইক্রোবিয়াল রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে ক্ষতিকর অনুজীবকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন মাটিতে জন্মানো এইসব অনুজীবের দেহে পাওয়া এই এন্টিমাইক্রোবিয়াল রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বানানো সম্ভব! এভাবেই পাওয়া যায় ১৯৫০ সালে স্যার আলেক্সজান্ডার ফ্লেমিং এর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার, অ্যান্টিবায়োটিক- পেনিসিলিন। পেনিসিলিনের সমগোত্রীয় স্ট্রেপ্টোমাইসিন আবিষ্কৃত হয় ডঃ সালমন ওয়াক্সম্যান এবং তার সহকর্মীদের হাত ধরে। যা ১৯৫২ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করে। উল্লেখ্য, ডঃ ওয়াক্সম্যানই একমাত্র মৃত্তিকা বিজ্ঞানী যিনি এই সম্মানজনক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ‘স্ট্রেপ্টোমাইসিন’ প্রথম ব্যবহৃত হয় যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে। এছাড়াও আছে টিউমার চিকিৎসায় ‘অ্যাকটিনোমাইসিন’, ত্বকের ক্ষত নিরাময়ে ‘নিওমাইসিন’ সহ প্রভৃতি অ্যান্টিবায়োটিক। ১৯৫৬ সালে ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে  ‘অ্যাকটিনোমাইসিট’ নামক অনুজীবের একটি প্রজাতি থেকে ‘ভ্যানকোমাইসিন’ অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়। মাটিকে ওষুধ নির্মানের প্রাকৃতিক ল্যাবরেটরি বললে খুব একটা ভুল হবে না! সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মৃত্তিকার পুষ্টি উপাদান এবং অনুকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা এই অনুজীব মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের এক অনন্য উপাদান।

New folder

মাটি শুধুমাত্র ক্ষুদ্র অনুজীবের আবাসস্থল, তা নয়। অনেক প্রাণিও মৃত্তিকাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে। প্রকৃতির লাঙ্গল নামে পরিচিত ‘কেঁচো’ যার মধ্যে অন্যতম। মাটিতে যত সংখ্যক প্রাণি বা ‘ম্যাক্রো অ্যানিম্যাল’ আছে, তাদের মধ্যে কেঁচো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেঁচোর প্রায় ৭০০০ এরও বেশি প্রজাতি পাওয়া যায় মাটিতে। এর সবচেয়ে উপকারি দিক হচ্ছে, এটি আর যাই খায় না কেনো কখনো উদ্ভিদের শিকড় খায় না, উদ্ভিদের ক্ষতি করে না। এটি মাটিতে গর্ত তৈরি করে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলে সহায়তা করে, মাটির গঠন ভালো রাখে, চাষের উপযোগী করে এবং মাটিকে উর্বর করে। মাটির উপরের ১৫-৩০ সে.মি. পর্যন্ত এর গাঠনিক এবং রাসায়নিক অবস্থা ভালো রাখে। আর সুস্থ মাটি মানেই স্বাস্থ্যকর মাটি এবং উর্বর মাটি, উর্বর মাটি মানেই এর পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে বিদ্যমান। যেখানে ফসল উৎপাদনের পরিমানেই শুধু ভালো হবে না, পুষ্টি উপাদানেও পরিপূর্ণ থাকবে। আর পুষ্টিকর খাবার মানেই সুস্থতার প্রতীক।

worm-tunnels-soil-550x358

উর্বর মাটিতে প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলো সঠিক পরিমানে বিদ্যমান থাকে। প্রথম এবং প্রধান পুষ্টি উপাদান হলো- নাইট্রোজেন। বিভিন্ন উৎস থেকে নাইট্রোজেন আসে। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বায়ুমন্ডল থেকে পাওয়া নাইট্রোজেন উদ্ভিদের মূলের নডিউলে সংযুক্ত হয় এবং মাটিস্থ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা প্রক্রিয়াজাত হয়ে উদ্ভিদের জন্য সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়াকে আমরা জানি, ‘নাইট্রোজেন সংবন্ধন প্রক্রিয়া’ অথবা ‘নাইট্রোজেন ফিক্সেশন’ নামে। কোনো না কোনোভাবে প্রায় প্রতিটি প্রাণি এবং উদ্ভিদের জীবন ধারণে নাইট্রোজেন ব্যবহৃত হয় । উর্বর মাটিতে অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, বোরোন উল্লেখযোগ্য। এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলো ছাড়া উদ্ভিদ তার সম্পূর্ণ জীবন চক্র সম্পন্ন করতে পারেনা। আপনার খাবারের তালিকায় ডাল-ভাত থেকে শুরু করে বার্গার পর্যন্ত দৈনিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের উপাদানগুলোর যোগান দেয় একমাত্র- মৃত্তিকা। বুঝতেই পারছেন তাহলে স্বাস্থ্যের সাথে মৃত্তিকার অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র।

maxresdefault

পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষায় মৃত্তিকার আরো একটি ভূমিকা আছে। পেট্রোল পাম্পে বা শিল্প কারখানার আশেপাশে প্রচুর পরিমানে জ্বালানীর উৎপন্ন হয়। গ্যাসোলিন এদের মধ্যে একটি। এই গ্যাসোলিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাটিতে বসবাসকারী অনুজীবগুলো এই গ্যাসোলিন খেয়ে ফেলে। দূষিত মাটিকে পরিষ্কার করে পরিবেশকে রাখে স্বাস্থ্যবান। দূষিত পানি পরিষ্কারেও মাটির ভূমিকা অনন্য। প্রাথমিকভাবে মাটিস্থ অনুজীব ব্যবহার করে জৈব পদার্থগুলোকে (Organic matter) ভেঙ্গে  উদ্বায়ী জৈব পদার্থ (Volatile organic compound) এবং হাইড্রোকার্বন কে নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি পরিশোধন করা হয়।

পাঠক তাহলে বুঝতেই পারছেন, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আপনার স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। কারন, মাটি জীবন ধারণ করে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics