ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার; ঐতিহ্য বনাম অধিকার !!!

ফারজানা হালিম নির্জন 

আয়রে আয় টিয়ে/নায়ে ভরা দিয়ে
না’ নিয়ে গেলো বোয়াল মাছে/তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে
ওরে ভোঁদড় ফিরে চা/খোকার নাচন দেখে যা

ছোট্টবেলার বাংলা ছড়া বইয়ের পাতায় পাতায় কত শত রূপকথা খেলা করতো! টিয়ে,বোয়ালের দুষ্টুমি দেখে খোকা আর ভোঁদড়ের একসাথে সে কী নাচ! সেই বয়সটা আমরা সবাই পার করে এসেছি। বাস্তবতার কড়াঘাতে হঠাৎ হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে চমকে উঠতে হয়। তখন আমরা বুঝি,খোকা আর ভোঁদর শুধু শৈশবের সেই ছড়া বইয়ের পাতাতেই মনের আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। টিয়ে আর বোয়ালের এক ফ্রেমে আসাটাই তো এখন দুষ্কর ব্যাপার! মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করেনা,আমাদের বিনোদনের খোরাক,সেই নাচনেওয়ালী ভোঁদররা এখন কী করছে? article-2585932-1C75383E00000578-692_964x642

বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে তাদের প্রকৃত নিবাস। সেখানেই তারা মনের সুখে নদীতে সাঁতার কাটে,আর নদীপথে ঘুরে ঘুরে খাবার শিকার করে। ছোট ছোট কেশাবৃত এই ভোঁদড়রা কিন্তু অলস জীবন-যাপনেই শুধু থেমে নেই। তারা প্রায় এক শতক আগে থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের সাথে দিন-রাত পরিশ্রম করছে! রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৩০ মাইল দূরের জেলা নড়াইলে ভোঁদড়দের ছাড়া জেলেরা যেন একেবারেই নিস্তেজ। পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে তাদের প্রধান এবং একমাত্র পেশা,মাছ ধরার কাজে ভোঁদড়রা এক অনবদ্য অংশ। ছবি দেখে হয়তো একটু কষ্টই লাগবে এই ভেবে যে এদেরকে কী নির্মমভাবেই না খাটানো হচ্ছে !বছরের পর বছর ধরে বন্যপ্রাণী আইনে কি অপরাধটাই না সংঘঠিত হচ্ছে প্রান্তিক জেলেদের হাত ধরে!! কিন্তু ছবির উল্টো পাশে চাপা পড়ে আছে অন্য কাহিণী। নড়াইলের এই জেলে পরিবারগুলোর জীবন-চাকা পুরোটাই যে এই ভোঁদড়দের কর্মক্ষমতার উপর! জেলেরা তাদের মাসিক আয়ের অর্ধেক পরিমাণ ব্যায় করে ভোঁদড়দের পরিচর্যা আর কাজ শেখানোর খাতে।article-2585932-1C75363A00000578-981_964x637 বিনিময়ে ভোঁদড়রাও জেলে পরিবারগুলোর দিকে সাহায্যের অকৃত্রিম ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক অনেক বছর আগে থেকেই। তারা ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে,কিন্তু নিজেদের জন্য নয়,জেলেদের জালে ফেলবার জন্য। এক একটা ভোঁড়র প্রায় ৩-৪ কেজি মাছ ধরতে পারে। কচুরীপানা আর জলজ পাতা সরিয়ে সরিয়ে মাছের সন্ধান এনে দেয় জেলেদের টুকরীতে। এমনই বিশ্বস্ত বন্ধু্র মত একসাথে কাজ করে জেলে আর ভোঁদড়। এই বন্ধুতায়,একদিকে যেমন খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে জেলে পরিবারগুলো,অন্যদিকে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ভোঁদড়রাও কেউ কেউ খামোশ খেয়ে টিকে আছে।article-2585932-1C75372C00000578-828_964x636
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ প্রায় ২৫ বছর ধরে ভোঁদড়ের সহায়তায় মাছ শিকারের এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর কথামতে,এই সময়ের মধ্যেই ভোঁদড় নির্ভর মাছ শিকারের সাথে জড়িত প্রায় ৫০০ পরিবার কমে এখন ১৫০ এ এসে ঠেকেছে। বাকী পরিবারগুলো আর পেরে উঠেনি তাদের এই জীবন-সংগ্রামে টিকে থাকতে। তিনি আশংকা করে বলেন,এভাবে চলতে থাকলে আর দুই দশকের মধ্যেই এই ভোঁদর নির্ভর পেশা পুরোপুরিই মুছে যাবে। নদীতে যেসব মাছের আধিক্য ছিলো,তারা প্রায় হারিয়ে গেছে অতিরিক্ত পরিমাণে নদী দূষণ আর সার ব্যবহারের ফলে । নদীতে যেখানে আগের মত মাছই পাওয়া যায়না,সেখানে ভোঁদড়রাই বা আর কোত্থেকে মাছ খুঁজে আনবে! আর যেটুকুই বা পাওয়া যায়,তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালানোতেইতো রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে,ভোঁদড়দের পেছনে খরচ করার সামর্থও যে তাদের আর নেই! article-2585932-1C75372200000578-882_964x641

অতঃপর,যে পরিবারগুলো এখনো এই পেশায় টিকে আছে,তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই। কারো ছেলে-মেয়ে,কিংবা কারো ছোট ছোট ভাই—বোনের পড়াশুনা চালানোর জন্য অভিভাবকরা তাদের পুরনো পেশা ছাড়তে পারেননি। সেই স্বপ্ন দেখানো শিশুগুলোর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে এই অসহায় পরিবারগুলো। একদিন তাঁদেরও দিন বদলে যাবে। কিন্তু ততদিনে যে ভোঁদড়রাও হারিয়ে যাবে! বেঁচে থাকার তীব্র আকাংক্ষার জন্যে যারা শ্রম দিয়ে মানুষদের সাহায্য করে যাচ্ছে,তাদেরকে আর কোথাও কি তখন দেখা যাবে? অথচ একটু অন্যভাবে ভাবিতো,যদি নদী দূষন না হতো ! যদি অনেক অনেক মাছে ভরে থাকতো বাংলার নদী-নালাগুলো! তাহলেতো এমন ভাবেই দক্ষিণ বাংলায় ভোঁদড়রা হাসতে খেলতে মাছ শিকার করে যেতো আরো অনেক অনেক দিন! এমনটা হলে হয়তো অনাগত শিশুদের আর হাত নেড়ে নেড়ে আবৃত্তি করে দেখানো ছড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকতোনা ভোঁদড় নাচের ইতিকথা।

কিন্তু তবুও সবশেষে কিছু কথা থেকেই যায়, এই ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা সংস্কৃতির বিপক্ষে অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে আজকাল। যেমন; ভোঁদড় একটি বন্যপ্রাণী, বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী পোষা বা এদের দিয়ে যেকোনো ধরনের জীবিকা নির্বাহ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সে হিসেবে, ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার একটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দিন- দিন, বছর- বছর এই চর্চাটি নানা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে লোপ পাচ্ছে ঠিক কিন্তু হারিয়ে যায়নি,কিন্তু শত বছরের পুরনো এই পেশায় যারা রয়েছেন তাঁরা যেহেতু দারিদ্রতার কষাঘাতে পিষ্টই হচ্ছেন তাহলে তাঁদেরকে এই পেশা ছেড়ে অন্য কোন পেশা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে কি?? কিংবা তাঁদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে এ পেশা ত্যাগ করতে সহায়তা করা হয়েছে কি?পাঠক; প্রশ্ন থাকলো।

ডেইলি মেইল থেকে আংশিক অনূদিত ও সম্পাদিত 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics