বাইক্কার বিলঃ হিজলের বন- পাখির ডানায় হারিয়ে যাওয়া

অনিমেষ ঘোষ অয়ন

মধ্য ডিসেম্বরের শুক্রবার।এমনিতেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় সারা সপ্তাহ ছুটি চলছে, তাই আলাদা করে শুক্রবার ছুটির দিন মনে হয়না। তবে একটি বিশেষ কারণে মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে।বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমরা তরুণরা এই অস্থিরতা থেকে কিছুটা মুক্তি খুঁজছি।অস্থিরতা উদ্দীপনা আর উত্তজনার ফলাফল খারাপ হলোনা,প্রকৃতির কাছেই আছে মুক্তি। ভাবনার সীমানা শেষ হলো আমাদের সেই শুক্রবার সকালে। সিলেট থেকে আমরা ১৮ জনের একটা দল;উদ্দেশ্য বাইক্কার বিল।পাখিডাকা কুয়াশায় ঢাকা চোখের দৃষ্টি সীমানা পেরুনো প্রিয় বাইক্কার বিল। প্রায় আড়াইঘন্টা ভ্রমণের পর যখন আমরা বরুনা বাজারে পৌঁছাই তখন ঘড়ির কাটা তিনটা ছুইছুই করছে। বরুনা বাজার; শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার মহাসড়কে অবস্থিত। বাজার থেকে পশ্চিম দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে,উচু-নিচু,কখনো মাটির মসৃণতা, দু’পাশে গাছের সারি,আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাসে ১০ কিমি দীর্ঘ এই রাস্তা শেষ হয়েছে বাইক্কার বিলে গিয়ে। এই ১০ কিমি রাস্তার শেষ ৪ কিমি হল মাটির রাস্তা, আমাদের গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে চলা শুরু করলো মনে হলো রীতিমত ‘বালিঝড়’ শুরু হয়ে গেছে!!! বেশকিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি বাইক্কার বিলের ‘তথ্য কেন্দ্র’র সামনে এসে দাঁড়ালো। বাইক্কার বিলের এই তথ্যকেন্দ্রটি বেশ যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করবেই। তথ্যকেন্দ্রে বাইক্কার বিল সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আছে; কী ধরনের কার্যক্রম এখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নেওয়া হয়েছে, কারা কারা এসব কার্যক্রমের সাথে জড়িত ইত্যাদি। এছাড়া এখানে কী ধরনের প্রাণী বৈচিত্র্য আছে এবং গত কয়েক বছরের এসবের সংখ্যা কী হারে পরিবর্তিত হয়েছে – এই সম্পর্কিত তথ্যও পেয়ে যাবেন এই তথ্যকেন্দ্র থেকে। তথ্যকেন্দ্রটি দেখা শেষে পা বাড়ালাম বিলে’র উদ্দেশ্যে। এখান থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই বিলের শুরু, যেখানে পাখি দেখার জন্যে তৈরি করে রাখা হয়েছে সুউচ্চ ‘ওয়াচ টাওয়ার’ আর এই হাঁটা পথেই রয়েছে ‘হিজল’ গাছের বন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় এই বন আরো  বিস্তৃত ছিলো। জ্বালানী কাঠের চাহিদা মেটাতে গিয়ে একসময় এখানে বন প্রায় ধবংস হয়ে পড়ে, সেই সাথে হুমকীর মুখে পড়ে বাইক্কার বিলের সমগ্র জীববৈচিত্র্য। তখন ( প্রায় ৯ বছর আগে) বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এই বিল রক্ষায় এগিয়ে আসে, স্থানীয়দের নিয়ে গঠন করে ‘বাইক্কার বিল সহব্যবস্থাপনা কমিটি’ ফলে এখন স্থানীয়রাই উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি এই বিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে বিগত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে এখানে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই হিজল বনের আয়তনও। মূলত এই গাছগুলোই বিলের পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে।

এই হিজল বন দেখতে দেখতে একটা জায়গায় এসে আবিস্কার করলাম আমরা হিজল বন পেরিয়ে চলে এসেছি আমাদের প্রিয় ‘বাইক্কার বিল’র কাছে! কারণ যেখানে এসে বনের শেষ হয়েছে সেখান থেকেই অপূর্বভাবে আমাদের সামনে ‘অপ্সরী’ বাইক্কার বিল এসে ধরা দিয়েছে!baikkar beel

চোখ দিয়ে দেখছি বাইক্কার বিলের সৌন্দর্য আর কান দিয়ে শুনে চলেছি পাখিদের কিচিরমিচিরের ছন্দ। বিলের পানিতে ভেসে থাকা পদ্মফুল যেন শীতের পাখিদের অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্যে এখানে ফুটে রয়েছে। পুরো বিল জুড়েই এই পদ্মফুল আর জলজ উদ্ভিদের রাজত্ব। খালি চোখে পাখি দেখে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না, তাই ঝটপট উঠে গেলাম ‘ওয়াচ টাওয়ার’র উপরে। এখানে পাখি দেখার জন্যে টেলিস্কোপের ব্যবস্থা আছে। যে কেউ চাইলেই একটি নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে পাখি দেখতে পারবেন। আর কোনো পাখি না চিনলেও সমস্যা নাই- এখানের দায়িত্ত্বে থাকা যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই পেয়ে যাবেন এর উত্তর।টেলিস্কোপে চোখ দিতেই আনন্দ যেন বাধভাঙ্গা আনন্দে পরিনত হল! এত পাখি!! বিলের যেখানে পদ্মফুল ছাড়া কিছুই আগে দেখিনি, সেখানে দেখছি পাখিগুলো বসে বসে ‘সূর্যস্নান’  করছে। একটু উপর দিয়ে উড়ে গেল ‘ছোট সরালী’র ঝাক, যদিও ভুল করে প্রথমে এদের পানকৌড়ি ভেবেছিলাম। তবে একটু পরে আমার ভুলকে শুদ্ধ করে দেবার জন্যেই হয়ত ২টি পানকৌড়ি একসাথে কোথা থেকে যেন উড়ে এল!DSC05663

একটু দূরেই দেখা গেল বেশ কয়েকটি ‘নেস্ট বক্স’ পাখি বিশেষজ্ঞ সায়েম ইউ চৌধুরীর কাছ থেকে প্রথম এই ‘নেস্ট বক্স’র ব্যাপারে জেনেছিলাম। এগুলো বানানো  হয়েছে মূলত ‘বালিহাস’ নামক এক ধরনের প্রজাতির নিরাপদ আবাসস্থল বানোর জন্যে। ২০০৯ সাল থেকে এই কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। গত কয়েকবছর যাবৎ এখানে আসা বালিহাস’গুলো এই ‘নেস্ট বক্স’এ আশ্রয় নেয় এবং প্রজননের মাধ্যমে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। ২০১২ সালেও এরা এখানে ডিম পেড়েছে এবং যথারীতি ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো তাদের মায়ের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছে মুক্ত আকাশে। উল্লেখ্য, একটা সময় আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এই প্রজাতির পাখির উপস্থিতি এখানে আশংকাজনকহারে কমে গেলে পাখি বিশেষজ্ঞদের তৎপরতায় এদের আবাসস্থল কৃত্তিমভাবে তৈরির মাধ্যমে এদের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বাড়ানো গেছে। সায়েম ভাইয়ের মাধ্যমে আরো জানা গেলো এই বিলে ‘কুড়া ঈগল’ নামক এক প্রজাতির পাখি দেখা যায় যা বিরল এক প্রজাতি। এছাড়া, এখানে হলদে বক, বাবলারের কয়েকটি প্রজাতি সহ বেশ কিছু বিরল প্রজাতি দেখা যায়। ২০০৯ সালেও এ বিলে ৩৪ প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ৪০ প্রজাতি হয়েছে। এদের মাঝে জলচর পাখি যেমন আছে তেমনি সৈকত পাখি সহ রয়েছে আমাদের দেশী প্রজাতির বিভিন্ন পাখি।

পাখি দেখতে দেখতে যখন সূর্য যখন বিলের পানিতে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমরা আবার তৈরি হলাম সিলেট ফিরে যাবার জন্যে। ফিরতি পথে আবার হিজল বনের ভেতর দিয়ে হেটে গেলাম। তবে এবার যেন হিজল বনটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ঘরে ফেরা পাখির কলকাকলিতে বনটি মুখ হয়ে আছে। সবাই কয়েক সেকেন্ডের জন্যে সেখানে দাঁড়িয়ে পাখির এই ছন্দময় সুর শুনতে লাগলাম কিছুক্ষণ, মন ভরে। কে জানে আর কবে আসবো ফিরে, আবার কবে ছন্দময়ে সুরে হারিয়ে যেতে পারব?

একথা সত্য যে, এই বিলে একসময় আরো বেশি পাখি দেখা যেত। তবে আশার কথা হল, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের সহযোগীতায় এখানে যেভাবে পাখি নিয়ে গবেষনা ও এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে তা অদূর ভবিষ্যতে এ বিলের প্রাকৃতিক সম্পদকে যে আরো সমৃদ্ধ করবে তা বর্তমানে থেকেই বলা যায়।তবে এর জন্য দরকার আমাদের সচেতনতা। যেমনটি আমরা করেছি, কোনো ধরনের খাবারের প্যাকেট বাইক্কার বিলে ফেলে আসি নি। বাইক্কার বিলে জোরেশোরে কোনো শব্দ করিনি। পাঠক আশা করবো আপনারা যারা যাবেন তারা এইরকম অভ্যাস গড়ে তোলে বাইক্কার বিলের মতন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যাবেন। কে জানে, হয়ত আপনার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস ভবিষ্যতের বৃহৎ সাফল্যের সূচনা হতে পারে।

লেখকঃ সভাপতি, গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics