উৎসব এবং সচেতনতার আহবানে পালিত হলো 'বিশ্ব পরিযায়ী পাখি উৎসব ২০১৫'

মনিজা মনজুর

ন্যাচার স্টাডি অ্যান্ড কনজারভেশন ক্লাব এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে গতকাল ৯ মে সারাদিনব্যাপী নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হলো ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি উৎসব ২০১৫’ (World Migratory Bird Festival 2015) । দিনব্যাপি স্বনামধন্য পাখি গবেষক এবং পাখি প্রেমীদের পদচারণায় মুখর ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘পাখিবান্ধব হোক সকল শক্তির উৎস’।

সকাল ৯ টায় দিলীপ কুমার দাশ এর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের সূচনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনির্বাণ সরকার। উক্ত আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক মোঃ সেলিম ভূঁইয়া, কোষাধক্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ অতিথিদের মাঝে ছিলেন- মুকিত মজুমদার বাবু, চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন; অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ । এছাড়াও বক্তব্য রাখেন মোঃ হাতেম, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিকেএমইএ এবং ডঃ মোঃ আবদুল আলীম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় । আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এর পত্রিকা ‘বাংলার পাখি’র সম্পাদক কাজী আহমেদ হোসেন।
11261847_951963388157446_1774209496669969901_n

অনুষ্ঠানে বক্তারা পরিবেশের সুস্থতা নির্দেশে পাখির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক খাতও যাতে পরিবেশ বান্ধব হয় সেই ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিকেএমইএ এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ হাতেম। মুকিত মজুমদার বাবু তার বক্তব্যের মাধ্যমে জানান পাখি শুমারিতে গত বছরের তুলনায় এই বছর পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যথাযথ আইনের প্রয়োগ এবং পরিবার থেকেই যাতে পাখি সংরক্ষণে সচেতনতার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় সে ব্যাপারে তি্নি গুরুত্বারোপ করেন। ক্ষমতার সাথে মমতা মিশিয়ে যাতে সকলে যার যার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার অনুরোধ করেন তিনি। এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, পরিযায়ী পাখির চলাচলের সুবিধার্থে High tension cable এ রঙ্গিন বল এবং turbine এর পাখার গতি কমিয়ে আনা হয়েছে, যাতে পাখি দূর থেকে দেখে সতর্ক হতে পারে। পরিযায়ী পাখির উপকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এরা পোকামাকড় খায়, এদের উচ্ছিষ্ট ভালো সার হিসেবে কাজ করে। তাই পাখি খাবো না, পাখি শিকার করব না, এবং একে রক্ষা করব’।

বক্তব্য রাখছেন,জনাব মুকিত মজুমদার বাবু
বক্তব্য রাখছেন,জনাব মুকিত মজুমদার বাবু

জালাল আহমেদ অর্থ মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত হলেও তিনি একজন পাখি প্রেমী এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য। ‘চামচ ঠুঁটো বাটান’ (Spoonbill sandpiper)  সহ আরো বেশ কিছু পরিযায়ী পাখিদের সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের অবগত করেছেন।

‘পাখি এবং মানুষ একে অন্যের জন্য প্রয়োজন’- প্রধান অতিথি অধ্যাপক মোঃ সেলিম ভূঁইয়ার এ মূল্যবান বক্তব্যের পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডঃ মোঃ সাইফুল ইসলাম তাঁর সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানের পর বর্ণাঢ্য র‍্যালীর আয়োজন করা হয়। র‍্যালীতে আমন্ত্রিত অতিথি সহ, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। র‍্যালীটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাংগন থেকে শুরু হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে শেষ হয়।

র‍্যালীর একাংশ
র‍্যালীর একাংশে অতিথিবৃন্দ

এরপরেই শুরু হয় ছোটদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা। রঙ তুলির আঁচড়ে পাখির প্রতি ভালোবাসা তুলে ধরে এই ক্ষুদে চিত্রশিল্পীরা। আর বিচারকের বিচারে গ্রুপ-এ তে প্রথম হয় নাইম ইবনে ফেরদৌস, সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলো, দ্বিতীয় সৈয়দ তরিকুল ইসলাম এবং তৃতীয় হয় ইফফাত সানিয়া রাফা, মনিপুর হাই স্কুল। গ্রুপ- বি তে প্রথম স্থান অধিকার করে হাবিবা জাহান, বাংলাবাজার হাই স্কুল এবং দ্বিতীয় হয় মুহসানা বিনতে ফেরদৌস, সেন্ট জেভিয়ারস হাই স্কুল।

মনোযোগ দিয়ে চলছে পাখির ছবি আঁকা
মনোযোগ দিয়ে চলছে পাখির ছবি আঁকা

বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ছিল প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, ন্যাচার স্টাডি অ্যান্ড কনজারভেশন ক্লাব, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিয়্যু সেন্টার (ডব্লিউ.আর.সি.), বাংলাদেশ সিটাশিয়ান ডাইভার্সিটি প্রজেক্ট (বি.সি.ডি.পি.), এনভায়রনমেন্টমুভ ডট কম, নেচার  কনজারভেশন ইনিসিয়েটিভ এর স্টল।

আলোকচিত্র আর দেয়ালপত্রিকাও ছিল পাখির কলতানে মুখর। প্রায় ৫০ জন পাখিপ্রেমী আলোকচিত্রী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতিযোগিতা্র বিচারকার্য সম্পন্ন করেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব। তাদের বিচারে প্রথম স্থান অর্জন করেন নাফিস আমিন, দ্বিতীয় ইকবাল হোসেন বাবু এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করেন কাজী আজহার উদ্দিন।

চলছে সেরা আলোকচিত্র বাছাইয়ের বিচারকাজ
চলছে সেরা আলোকচিত্র বাছাইয়ের কাজ
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া পাখিপ্রেমী আলোকচিত্রীরা
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া পাখিপ্রেমী আলোকচিত্রীরা

এর পরপরি শুরু হয় টানটান উত্তেজনায় ভরপুর বিতর্ক প্রতিযোগিতা। “দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রামপাল নয়, সুন্দরবনের ভূমিকাই মুখ্য” এই বিষয়ে স্কুল পর্যায়ে পক্ষের দল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আশনা আঞ্জুম, আতিয়া মাইশা এবং তাদের দলনেতা অদিতি বৈরাগী এবং বিপক্ষের দল সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের কামরুল ইসলাম, রিদাস সালাহিন জাওয়াদ, এবং তাদের দলনেতা মো আশরাফুল গালিব একে অন্যকে তির্যক বাক্যবানে এতোটাই জর্জরিত করে, যে শেষ পর্যন্ত তা টাইব্রেকারে গিয়ে গড়ায়। যুক্তি-তর্কের যুদ্ধে অবশেষে জয়ী হয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল। সেরা বক্তা হন অদিতি বৈরাগী।

তর্কযুদ্ধের ক্ষুদে সেনানী
তর্কযুদ্ধের ক্ষুদে সেনানী

ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে বাকযুদ্ধে অবতীর্ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ‘পাখির আবাসস্থল ধ্বংসে নগরায়নের ভূমিকাই মুখ্য’- এর পক্ষে যুক্তি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদেরকে যুক্তির যুদ্ধে হারিয়ে দেয় বিপক্ষ দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইব্রাহিম খলিল। এই দলে আরো ছিলেন জয়া দত্ত এবং আনোয়ার হোসেন। তর্কযুদ্ধের বিচারকার্যে যুক্ত ছিলেন ডঃ মোঃ আবদুল আলীম সহকারী অধ্যাপক অনির্বাণ সরকার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সামিয়া ফারজানা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  তার্কিকরা ছিলেন শুভ কুমার সাহা, সাবরিনা সাব্বির এবং তাদের দলনেতা হুমায়রা মাহমুদ।

তর্কযুদ্ধের আরেক বিজয়ী দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তি-তর্কে বিজয়ী দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য পাখি নিয়ে puzzle game এর আয়োজন করা হয়। বাংলাবাজার সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। সুরের তালে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে অন্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে জয়ী হন শাহরিন আক্তার, দ্বিতীয় হন পূর্নিমা সাহা এবং তৃতীয় হন নুসরাত জাহান ইশিতা। পাখি নিয়ে এমন একটি আয়োজনে অংশ নিতে পেরে আমন্ত্রিত অতিথি এবং দর্শকরাও উচ্ছসিত।

এছাড়াও ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত কুইজ যেখানে লটারির মাধ্যমে  বিজয়ী হন মুন্তাসির আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; দ্বিতীয় সুরাইয়া জামান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৃতীয় হন মো আবু ইউঁসুফ আল আস্কার, এসিআই অ্যানিম্যাল হেল্‌থ।

আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পাখি চেনা প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নেয়। বিজয়ী দল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশিষ কুমার দত্ত এবং মনীষা দে ইভা। রানার্স আপ দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মো মিজানুর রহমান এবং সুরভি আহমেদ।

মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন প্রানিবিদ্যা বিভাগের প্রিয়াঙ্কা হালদার, তাসনিমা হাসান আনিকা এবং স্বীকৃতি বর্ধন। নাচ পরিবেশন করেন স্বীকৃতি বর্ধন এবং নাটিকা পরিবেশনে ছিলেন রাজু ও তার দল। এরপরই বিজয়ী প্রতিযোগীদের হাতে পুরষ্কার এবং সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

এই প্রতিবেদনের আলোকচিত্র কৃতজ্ঞতায় লিসান আসিব খান

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics