পরিবেশবান্ধব সামুদ্রিক পর্যটনের সম্ভাবনা

মোহাম্মদ আরজু

পর্যটনকে শিল্পখাত হিসেবে ১৯৯৯ সালে স্বীকৃতি দেয় সরকার। কিন্তু পরিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষাকে ভিত্তি করে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠির আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই পর্যটনের কোনো উদ্যোগ এযাবত নেয়া হয়নি। কাজেই এখানে সামগ্রিক পর্যটনখাতের মত সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পর্যটনও জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখ করার মতো অবদান রাখতে পারেনি। উল্টো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নজির তৈরি হয়েছে যে, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি নষ্টে পর্যটন কর্মকাণ্ড সরাসরি ভূমিকা রেখেছে- যা দীর্ঘমেয়াদে খোদ শিল্প খাতটিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে ৭১০ কিলোমিটার লম্বা উপকূল রেখা ছুঁয়ে আছে বাংলাদেশ। সবমিলে উপকূলীয় ভূখন্ডের আয়তন ৪৭,২০১ বর্গকিলোমিটার। ১৯টি প্রশাসনিক জেলা রয়েছে এখানে। উপকূল ও সমুদ্র ছোটোবড় মিলিয়ে ৭৫টি দ্বীপ রয়েছে বাংলাদেশের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউট প্রকাশিত একটি মানচিত্রে দেখানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক সালিশিতে সীমানা নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশের সমুদ্র প্রদেশের মোট আয়তন ১,২১,১১০ বর্গকিলোমিটার।

এই উপকূলীয় ও সামুদ্রিক অঞ্চলে রয়েছে অনেক ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থান ও প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা; যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থানও হতে পারে একইসঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে, গভীর সমুদ্রের জলজ প্রাণবৈচিত্র্য, প্রবাল বসতি, সামুদ্রিক ঘাস কেন্দ্রিক জলজ বসতি, বালুময় সমুদ্র সৈকত, বালিয়াড়ি, জলাভূমি, প্লাবন অববাহিকা, মোহনা, উপদ্বীপ, লেগুন, নানা ধরনের দ্বীপ এবং ম্যানগ্রোভ। দেশের মোট ২৫টি প্রাণ-প্রতিবেশগত অঞ্চলের মধ্যে ১১টি’ই উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত, আরো ৪টির অংশবিশেষ এ অঞ্চলে পড়েছে। এই অঞ্চলে ১০টি বণ্যপ্রাণি অভয়ারণ্য, ৫টি জাতীয় উদ্যান এবং ১৭টি মৎস্য অভয়ারণ্য রয়েছে।World tourism day 2014

প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক অঞ্চলে সম্ভাব্য পর্যটনস্থানের সংখ্যা অনেক হলেও এর খুব কম স্থানেই পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে। এযাবত কয়েকটি সমুদ্রসৈকত ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে পর্যটন চলছে। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন এলাকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, নিঝুম দ্বীপ, মহেশখালী দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার সৈকত, টেকনাফ উপদ্বীপ, টেকনাফ সৈকত ও সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ।

তবে বিশ্বজুড়ে চালু সামুদ্রিক পর্যটন কর্মকান্ড যেমন; উইন্ড সার্ফিং, মাছ ধরা, সি কায়াকিং ও পালটানা নৌকা বাওয়া ইত্যাদি পর্যটন পণ্য বাংলাদেশে নেই। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি ও পাখি দেখা ও নৌভ্রমণের সামান্য যে সুযোগ আছে তা আনুষ্ঠানিক পর্যটনশিল্পখাতের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং প্রকৃতিউৎসাহী হাতেগোনা দুএকটি গোষ্ঠি (যেমন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব) এসব আয়োজন করে কদাচিৎ। স্কুবা ডাইভিং ও স্নরকেলিংও আনুষ্ঠানিক পর্যটন শিল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। সেভ আওয়ার সির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এসএম আতিকুর রহমানের উদ্যোগে এই সেবা চালু রয়েছে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ ঘিরে প্রবাল বসতিতে, খুবই সীমিত পরিসরে।

উপকূলে ও সমুদ্রে যথার্থ পর্যটন পণ্য ও সেবা অনুপস্থিত; পর্যটন খাতে আয় সামান্য; কিন্তু দায়িত্বহীন পর্যটন ধারার কারণে খোদ প্রতিবেশগত পর্যটন স্থানগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব পর্যটনস্থানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর এই স্থানগুলোতে যেধরণের আচরণ করা ও না করা জরুরি, তার কোনো নির্দেশনা, আয়োজন বা বাধ্যবাধকতা- কিছুই নেই। যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই।

দুঃখজনক দৃষ্টান্ত

সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ ঘিরে সাগরে প্রবাল ও সামুদ্রিক শৈবাল কেন্দ্রিক বাস্তুসংস্থানটিতে গত তিনবছর ধরে জরিপ ও সমীক্ষা চালাচ্ছে ‘সেভ আওয়ার সি’। লক্ষ্য; এর একটি সম্ভাব্য সীমানা শনাক্ত করা এবং প্রাণের প্রজাতিগুলো চিহ্নিত করা। দ্বীপটিতে নব্বইর দশক পর্যন্ত পর্যটকের চাপ ছিল না। নব্বই দশকের পরে ক্রমাগত হোটেল মোটেল বেড়েছে। ২০০৩ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মূল খন্ডের সাথে পর্যটক জাহাজ চালু হয়। এখন সেখানে হোটেল-মোটেল এমন সংখ্যায় বেড়েছে যে সেখানে আর বাড়ানোরও জায়গা নেই।

পর্যটনের এমন বাড়বাড়ন্তের পরও প্রবাল বসতিটিকে দূষণমুক্ত রাখার দিকে কোনো উদ্যোগ গত এক দশকে পর্যটনসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই নেয়নি। কোনো ধরণের বিশেষ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই পর্যটন কর্মকান্ড চলছে এখানে। প্রতিদিন পাঁচছটি জাহাজ একেবারে দ্বীপের গায়ে ভেড়ে, এসব জাহাজের প্রপেলারের তীব্র ঢেউয়ে প্রবাল বসতিতে পলি ছড়ায়। প্রবালের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ২০০৮-এর আগে নেয়া হিসাব অনুসারে পর্যটন মৌসুমে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে, দ্বীপটিতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩,০০০ পর্যটক যান। অথচ অপচনশীল জিনিসপত্র সরিয়ে আনা বা পুনঃব্যবহারযোগ্য করবার কোনোও ব্যবস্থা নেই দ্বীপে। জলজ পরিবেশ ও প্রাণের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য সাগরেই ফেলা হয়।[i] আবাসিক হোটেলগুলো থেকে মনুষ্য বর্জ্য, ক্ষতিকর রাসায়নিক, কীটনাশক, সাবান, ডিটারজেন্ট ও ব্লিচিং পাউডার সরাসরি সাগরজল দূষিত করছে। যেখানে একসময় সমৃদ্ধ প্রবাল-বসতি ছিল, কিন্তু নৌকা-নোঙর আর বর্জ্যের প্রভাবে এখন তার নাম নিশানা মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে।

এই হোলো পরিবেশ-অসচেতন পর্যটনের পরিহাস। একটা দ্বীপকে প্রবাল দ্বীপ বলে ডেকে ডেকে পর্যটকদের নেয়া হচ্ছে। অথচ সামুদ্রিক পর্যটন কর্মকান্ড; স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং, উইন্ড সার্ফিং, মাছ ধরা, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি ও পাখি দেখা, নৌভ্রমণ প্রভৃতি কোনোটিরই সুযোগ নেই সেখানে। প্রবাল দ্বীপে গিয়ে প্রবাল না দেখেই ফিরে আসতে হয় তাদের। অথচ এই দায়িত্বহীন পর্যটনের পরিণতিতে প্রবাল বসতিটিই বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সম্ভাবনার সহায়

জাতীয় পর্যটন নীতি ২০০৯-এর ভূমিকায় বলা হয়েছে ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ পর্যটন সম্ভাবনার দেশ।’ নীতিমালার ভূমিকাতে বাংলাদেশের যেসব পর্যটন আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই হয় সামুদ্রিক নয়তো উপকূলীয়। নীতিমালার ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’-এ ‘টেকসই’ পর্যটন গড়াকেই প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে; ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে টেকসই পর্যটন উন্নয়ন সাধন হচ্ছে এই নীতির মূল লক্ষ্য।’ তবে এই টেকসই পর্যটন কিভাবে গড়ে হবে তার কোনো নির্দেশনা এতে নেই। বিক্ষিপ্তভাবে ‘ইকো-ট্যুরিজমে’র কথা বলা হয়েছে, সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। অথচ বাংলাদেশের মত নদীমাতৃক ও উপকূলীয় দেশে পর্যটন নীতিমালাটি অন্তর্নিহিতভাবেই পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ধারার হবার কথা। করণ এখানে পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও পণ্য সেবার অভাব কাটিয়ে ওঠাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এতের উতরে গেলে দুর্বলতর শিল্পখাতটিকে টেকসই ভিত্তি দেয়া সম্ভব।

এই সম্ভাবনা ইতোমধ্যেই সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশ। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংখ্যার নানা পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশ বাড়াতে পর্যটন খুবই শক্তিশালী উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে ২০টিতেই পর্যটন হচ্ছে রফতানি আয়ের প্রধান বা দ্বিতীয় প্রধান উৎস। অনেক উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষত ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশগুলোতে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ২৫ ভাগই পর্যটন থেকে আসছে। এবং পূর্বাভাস হচ্ছে; ২০১৫ সাল থেকে প্রথমবারের মত পর্যটনে উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো; এসব দেশে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে।

পর্যটন খাতে এমন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য আমাদের জরুরি সুপারিশ হচ্ছে; ১. সামুদ্রিক ও উপকূলীয় পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা সংশোধন করা। ২. পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠির উন্নয়ন হয় সে লক্ষ্যে আইনি পরিকাঠামো তৈরি করা। ৩. পর্যটন খাতটিকে বর্তমান অবস্থা থেকে টেকসই ভিত্তিতে নেয়ার প্রক্রিয়ায় প্রধান নেতৃত্বের ভূমিকায় বেসরকারি খাতকে নিয়ে আসতে নীতিগত ও আইনি পরিকাঠামো তৈরি করা।

মোহাম্মদ আরজু: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সেভ আওয়ার সি arju@saveoursea.social

(বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০১৪ উপলক্ষে বাপা, পিপলস সার্ক ওয়াটার ফোরাম এবং এসওএস আয়োজিত আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত। প্রবন্ধটিতে গবেষণা সহযোগী হিসেবে ছিলেন এসওএসের নলেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমুনিকেশন ভলান্টার ফারজানা মনি)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics