অন্তহীন রুপের প্রকৃতি : হালতির বিল

লিসান আসিব খান

পালা বদলের খেলায় ঋতু পরিবর্তন ঘটে। ঋতুতে ঋতুতে বদলে যায় প্রকৃতির রুপ । আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ ধরে ছুটে চলছেন আপনি, আর দু পাশে নারকেল গাছগুলো তার ডালগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে । ভুলে যেতে পারেন যান্ত্রিক জীবনের দৌড়ঝাঁপ। সত্যিই তখন মনে হবে প্রকৃতিই পারে মানুষকে নির্মল আনন্দ দিতে।

সে যে সবুজ আর স্বচ্ছ জলের কি এক প্রেমকাব্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে বইলের তলানী পর্যন্ত । স্বচ্ছ পানির নিচে সবুজ ঘাষ আর মাছেরা খেলা করে আপন খেয়ালে। দেখলেই মন চাইবে ঝাপিয়ে পড়ে পরাণ জুড়াই। এ এমনই এক মায়াবী বিল “ হালতির বিল ” যা শহুরে কর্মচঞ্চল মানুষক নতুন এক জীবন দেয়।

হালতির বিলে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে নাটোর শহরের হরিষপুর বাইপাসে নামতে হবে। সেখান থেকে ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা দিয়ে উত্তরা গন ভবন এর পাশ দিয়ে প্রায় ১২ কিঃমি আঁকা বাঁকা সরু পথ পাড়ি দিলেই আপনি পৌঁছে যাবেন হালতির বিলে। তার জন্য জন প্রতি ১৫ টাকা ভাড়া গুনতে হবে আপনাকে। সন্ধ্যার পর এই রাস্তাটি সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে বলে সন্ধ্যার আগেই জায়গাটি ত্যাগ করা শ্রেয়।

IMG_1889

এ পথে সচরাচর কোনো বড় বাস বা গাড়ি দেখা যায় না। কারণ গ্রামের সরু পথ ধরে জেতে হয় এই বিলে ।নাটোরে শহর থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগবে হালতির বিলে যেতে। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ আপনাকে বিমোহিত করবে ।

বেড়াবার পক্ষে হালতির বিলের আবহাওয়া সারা বছরই দারুণ সুন্দর। সারাদিন চলে শীতল বাতাস, তাই গরম ততটা বোঝা যায় না। তবে দূষণের মাত্রা কম বলে সূর্যালোক খুব জোরাল ।

হালতির বিল একেবারে অলাদা, সব কিছুর বাহিরে। এখানে নেই বাতির ঝলক কিংবা যান্ত্রিক কোন বাহনের বিকট শব্দ, নিঝুম নিশ্চুপ। এ যেন প্রকৃতির একটি আলাদা সত্ত্বা। হালতির বিলে যে কয়টি উপভোগ্য বিষয় আছে তার ভিতর বিকেলের সূর্যাস্ত আর একটি অপরূপ দৃশ্য।

IMG_1946               বিলের পাড়ে দাড়িয়ে আপনি উপভোগ করতে পারেন এই দৃশ্য।

আপনি নিজেকে ভাগ্যবান দাবী করতে পারেন যদি রাতটি হয় পূর্নিমা রাত। নিঃশব্দ দ্বীপের খোলা মাঠে শুয়ে আকাশের তারা দেখার সৌভাগ্য কজনারই বা হয়?
তাইতো কবির কণ্ঠে –
“দেখেছি দশটা চাঁদ দশটা পুকুরে
খেলা করে, ডুব দেয় রাত্রি দুপুরে।
কি ভালো সাঁতারু ওরা, কি ভালো ডুবুরি
মাছে আর চাঁদে হয় খুব লুকোচুরি”

IMG_1866                                                বিল থেকে ধরা তরতাজা মাছ

স্থানীয়দের মতে মাছের অভয়আরণ্য বলা হয় এই বিলকে ।ছোট বড় নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এই বিলে ।

হালতির বিল এমন একটি রাজ্য, যে রাজ্যের অধিপতি সরালি, পানকৌড়ি, বালিহাঁস, বক, দলপিপি, জলপিপি সবাই। নৌকা নিয়ে বিলের মাঝে দিয়ে পারি দিলে সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাবে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো একঝাঁক সরালি। । পরক্ষণেই ডুব দিলো একটি পানকৌড়ি, ভুঁস কেটে উঠলো আরেকটি। পুরো হালতির বিলটা যেন সুন্দর এ পাখিটির দখলে।

বিলের দুই পাশে রয়েছে দুটি টি ঘাট একটি পাটুল, অন্যটি খাজুরা । পাটুল থেকে খাজুরা পর্যন্ত বিলের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে পাকা রাস্তা যা বর্ষাকালে ১২ হাত পানির নিচে থাকে।

IMG_1993

খোলাবাড়িয়া, দিঘিরপাড় একডালা এবং হালতি এই চারটি গ্রাম নিয়ে পরিবেষ্টিত হালতির বিল। বলা চলে হালতি গ্রামের নামানুসারেই এই বিলের নামকরন করা হয়েছে ।IMG_2016

বর্ষাকালে এই চার গ্রাম বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হল নৌকা। কেননা আষাঢ় থেকে আশ্বিন এই চার মাস গ্রাম গুলো পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাবার জন্য তারা বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে। যা চলা-চলের জন্য খুবই বিপদজনক।

IMG_2031

শুকনো মৌসুমে ইরি ধানের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে এই গ্রামের বাসিন্দারা। যেই পরিমান ধান পায় তা দিয়েই তাদের সারা বছর চলে যায়।

বর্ষা মৌসুমে গ্রামের ৬০–৭০% লোক নৌকা চালিয়ে টাকা উপার্জন করে থাকে। ঘণ্টাপ্রতি ১০০ টাকা দিয়ে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন পুরো হালতির বিল।

এই বিলের পাশেই আছে পানিতে ভাসমান কিছু দোকান পাট। স্থানীয় বাসিন্দায়ের দাবি এইসব দোকানপাটের উচ্ছিষ্ট অংশ প্রতিনিয়ত বিলের পানিতে ফেলা হচ্ছে যা বিলের পানিকে দূষিত করে তুলছে। IMG_1869

সতর্কতা:  মনের ভুলেও পাখিদের বিরক্ত করবেন না। হালতির বিল মাছের অভয়ারণ্য। ঢিল ছুড়বেন না, কিছু খেয়ে ফেলবেন না জলে। অযথা চিৎকার করবেন না।

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics