গাজনার বিল : লোকচক্ষুর অন্তরালে নীলাভ বিল

লিসান আসিব খান

ভাবুন আপনি নীল আকাশের সাদা মেঘের ছায়ায় সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন আর আপনার দু পাশে স্বচ্ছ নীল পানি খেলা করছে , আছড়ে পড়ছে রাস্তার দু পাশে । এটি কোন স্বপ্নের কথা বলছি না , ইচ্ছে করলে আপনিও স্বপ্নের দেশে হারিয়ে যেতে পারেন কিছু সময়ের জন্য ।

এমনই একটি নয়াভিরাম অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক শোভায় আচ্ছাদিত “গাজনার বিল”।

এই বিলটিকে এক নজর দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে পাবনা জেলার সুজানরগর থানায় । রাস্তা ঘাট উন্নত হবার কারণে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটক ভিড় করে এই বিলের নির্মল পরিবেশে কিছু সময় কাটানোর জন্য ।

আষাঢ় থেকে আর্শিন এই চার মাস পানিতে কানায় কানায় ভরে উঠে এই বিল । ছোট-বড় ১৬টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত গাজনার বিল । স্বচ্ছ নীলাভ পানির নিচে ছোট ছোট মাছে খেলা দেখে আপনি হয়তবা শৈশবের সৃতি ফিরে পেতে পারেন । IMG_20140916_120124

যমুনা নদীর সাথে সংযুক্ত এই বিলটির মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা রাস্তাকে ছোট ছোট ৪টি সেতু দিয়েছে অন্য এক রূপ ।এই বিলের আয়তন ১৭ হাজার হেক্টর। এই বিলের পানির প্রবাহ চলমান রাখতে ২০১২ সালে সেতু এবং রাস্তা নির্মাণ করা হয় । বিলের খুব কাছাকাছি আছে একটি সুইচ গেট, যার সাহায্যে এই বিলের পানি নিয়ন্ত্রন করা হয় ।

IMG_20140916_125307

বিলের পাশে হাঁটতে হাঁটতে আপনার চোখে পড়বে অনেক প্রজাতির শামুক ।দল বেঁধে তারা রাস্তার দু পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যা সত্যিই বিলের পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলে। গাজনার বিল থেকে প্রতি বছর ঝিনুক কুড়ায় এক শ্রেণীর শ্রমিক। এরা ঝিনুক শ্রমিক ও চুন্নকার নামে পরিচিত । প্রতিদিন রোজগার করে কমপক্ষে এক থেকে দেড় হাজার টাকা । কাক ডাকা ভোর থেকে দলে দলে এরা ঝিনুক কুড়াতে আসে বিলে। বিরামহীনভাবে এদের কার্যক্রম চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে বস্তা বস্তা ঝিনুক আর অমূল্য সম্পদ মুক্তা নিয়ে। এই ঝিনুক থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ মুক্তা সংগ্রহ হয় তার দাম প্রায় অর্ধ কোটি টাকা । আর এসব ঝিনুক থেকে তৈরি হয় মুরগির খাবার, মাছের খাবার ও পান খাবার চুন। এই তৈরি চুন উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার চাহিদা পূরণ করে।IMG_20140916_121227

এই বিলের আশেপাশে অল্প কিছু জনবসতি আছে । বিংশ শতাব্দীতে এসে যেখানে শহরের মানুষজন আমরা পরিবেশ সম্পর্কে অনেকটাই উদাসীন সেখানে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের সবার ঘরে রয়েছে পরিবেশ বান্ধব সোলার প্যানেল । এনজিও  ব্র্যাক, আশা , সিসিডিবি তাদেরকে ঋণ দিয়ে থাকে ।

IMG_20140916_123437 (1)

স্থানীও একজন কৃষক এর সাথে কথা বলে জানা গেল , সারা বছরই তারা এই বিলে পাট , ধান , পিচ এর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এই বিলে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে জানালো ষাটঊর্ধ্ব এই বৃদ্ধা । তিনি আরও বলেন , দেড় শতক আগেও এ অঞলে ২৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত । কিন্তু এখন এ অঞলে দেশী প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে পাবদা ,সরপুটি ,কই ,বাইস, শোল চেলা, বাজারি, ভেদা সহ ৫০ প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে । যদি নদ-নদী গুলো সংস্কার করা হতো তা হলে মাছের উৎপাদন বাড়তো । কিন্তু জেলে সম্প্রদায় এর সে আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে । IMG_20140916_131836 (1)

 ২০০ বছর ধরে বেড়ে উঠা এই বট গাছ আজও বিলের অনেক স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছে। এই বট গাছের পাশ দিয়েই রয়েছে পাকা রাস্তা কিন্তু বর্ষার সময় ১০ হাত পানিতে নিমজ্জিত থাকে এই রাস্তাটি ।

গাজনার বিল হলো এ উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহের মূলকেন্দ্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওই বিলকে ঘিরে প্রায় সাড়ে ৪শ কোটি টাকা ব্যয়ে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ সব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বিল খনন, শুকনা মৌসুমে বিলে পানি সরবরাহের লক্ষ্যে পাম্প হাউস নির্মাণ, বিলে মৎস্য অভয়ারণ্য তৈরি ও জীববৈচিত্র্য বিল পাড়ের মানুষকে বনজ সম্পদে সমৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি।

তবে পাঠক, একটি কথা মনে না করিয়ে দিয়ে পারছিনা। এই বিল এবং এর জীববৈচিত্র্য আমাদের জাতীয় সম্পদ, এর সংরক্ষণ ও একে এর মতো করে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাই, ঘুরতে যাবার সময় খেয়াল রাখবেন, আপনার মাধ্যমে যেন এর কোন প্রকার ক্ষতি সাধন না হয়। প্লাস্টিক প্যাক, খাবারের উচ্ছিষ্ট, কিংবা যেকোনো আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকবেন, কোলাহল হৈ- হুল্লোড় না করে যতটা সম্ভব নীরবে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করুন, আর প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিয়ে আপনার জীবনী শক্তি দিগুণ করে ফেলুন না…

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics