ক্যাকটাস বন্দনা !
দিব্য কান্তি দত্ত
‘ক্যাকটাস’ শব্দটা শোনার সাথে সাথেই আমার মাথায় যে স্মৃতিটা প্রথমে আসে সেটা হল, কাঁটাযুক্ত একটা গাছ যেটা আমার অনেক পছন্দের ছিল, আমার কিংবা আশেপাশের বাসার টবে লাগানো থাকত আর সুযোগ পেলেই আমি সেই গাছের শরীর থেকে কাঁটা টান দিয়ে আলাদা করে বন্ধুদের খোঁচাতে শুরু করতাম। অনেকেরই হয়ত ছোটবেলার এরকম স্মৃতি রয়েছে। অনেক বড় হয়েও ক্যাকটাসের মাত্র একটা প্রজাতির কথাই আমি জানতাম। সেটা ‘ফণীমনসা’। এই শব্দটার সাথেও সম্ভবত পরিচিতি নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘ফণীমনসা’ থেকে। আমেরিকান ব্যান্ড ‘পিক্সিস’ তাদের অ্যালবাম ‘সার্ফার রোজা’ তে তো ‘ক্যাকটাস’ নিয়ে পুরো একটা গানই বানিয়ে ফেলেছে! ‘ক্যাকটাস’ শব্দের উৎপত্তি গ্রীক ‘ক্যাকটা’ থেকে যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘শিরদাঁড়া যুক্ত কাঁটাওয়ালা গাছ’। যে ‘ক্যাকটাস’ নিয়ে এত হুলস্থূল সেটার শ্রেণিবিন্যাসটা একবার দেখে নিই।
Kingdom: Plantae
Phylum: Tracheophyta
Division: Magnoliophyta
Class: Dicotyledonae
Sub class: Caryophyllidae
Order: Caryophyllales
Family: Cactaceae
এর গণের সংখ্যা প্রায় ১০০ এর ওপর যার প্রায় ২৫০০ এর ওপর প্রজাতি রয়েছে। এদের আবার তিনটি গোত্রে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হল- Pereskieae, Opunitieae, Cactoidea. এদের ভিতর Cactoidea সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রজাতির ‘ক্যাকটাস’ ধারণ করে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রাচীন ‘অ্যাজটেক’ সভ্যতায় ‘ক্যাকটাস’এর নিদর্শন পাওয়া যায়। ৮০০ বছর আগে এক ঝড়ের রাতে প্রবল প্রতাপশালী অ্যাজটেক সম্রাট স্বপ্ন দেখলেন- বিশাল এক ক্যাকটাসের মাথায় বসে এক বিষধর সাপকে চঞ্চু আর নখর দিয়ে ফালি ফালি করে ছিড়ে খাচ্ছে পাখির রাজা ঈগল। রাজা ভেবেই নিলেন এ এক ঐশী বাণী। তারপর থেকে ‘অ্যাজটেক’ সভ্যতায় ক্যাকটাসের গুরুত্বই ছিল অন্যরকম।
এর আদি বাসভূমি আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম ইউরোপে ‘ক্যাকটাস’ নিয়ে আসেন। ‘Prickly pears’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কণ্টকিত নাশপাতি’। উনিশ শতকে এটি অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক শোভা বৃদ্ধিতে এবং এর পাশাপাশি রঞ্জক কারখানায়ও ব্যবহৃত হত। বিশ শতকে এর চাহিদা বিপুল পরিমাণে বাড়তে থাকে। এ জাতীয় গাছকে আমেরিকার নিজস্ব উদ্ভিদ বলে ধরা হয়। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া, মেক্সিকো, অ্যারিজোনা ও টেক্সাসের বিস্তৃত মরু অঞ্চলে এ উদ্ভিদের বন গড়ে উঠেছে।
এ উদ্ভিদের রয়েছে পানি সংকট দূরীকরণ ও পানি সংরক্ষণ ক্ষমতা। মরুভূমির প্রচুর উত্তপ্ত পরিবেশেও ‘ক্যাকটাস’ পানি সংরক্ষণ করতে পারে বলে এটি প্রায় দুইশ বছরের মত বাঁচতে পারে। বাংলাদেশে যে কয়েকটি প্রজাতির ক্যাকটাস রয়েছে তাদের মধ্যে একাইনো ক্যাকটাস, এপিফাইলাম, নিপল ক্যাকটাস, সেরেয়াস, গোল্ডেন ব্যারেল, ওল্ড লেডি, মাদার-ইন-ল চেয়ার, ফণীমনসা প্রধান। এশিয়ার সর্ববৃহৎ ক্যাকটাস নার্সারী ‘পাইন ভিউ নার্সারী’। এটি দার্জিলিং এর কালিম্পং এ অবস্থিত। এখানে কয়েক হাজার বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ‘ক্যাকটাস’ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ৫০ টি দেশ থেকে বার্ষিকভাবে প্রায় ৭ মিলিয়নের ওপর ‘ক্যাকটাস’ আমদানী করে। কিন্তু, একবিংশ শতাব্দীতে এই উদ্ভিদটির ব্যাপক চাহিদা এবং এর অনিয়ন্ত্রিত বাজারজাতকরণ প্রজাতিগুলোকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অলংকরণ, সাজসজ্জ্বা, ঔষধ, খাবার প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর অপরিসীম গুরুত্বের কারণে এর চাহিদা আকাশছোঁয়া পর্যায়ে চলে গেছে যা ক্যাকটাসের ৩১ শতাংশ প্রজাতিকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আইইউসিএন পরিচালিত একটি সমীক্ষার তথ্য যেটি সম্প্রতি ‘ন্যাচার প্ল্যান্টস’ নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাতে উঠে এসেছে এ ধরণের হতাশাজনক আরো কিছু তথ্য। একে আইইউসিএন-এর ট্যাক্সোনমিক গ্রুপের ‘রেড লিস্ট’ -এ পঞ্চম স্থানে রাখা হয়েছে। এর নিচে রয়েছে যথাক্রমে স্তন্যপায়ী এবং পাখির কিছু প্রজাতি।
পুরো পৃথিবীতে ক্যাকটাসের প্রায় ১৪৮০ টি প্রজাতি ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ ক্যাকটাসের বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্ন কারণে ব্যবহার করে থাকে। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে দিনের পর দিন ক্যাকটাসের বিভিন্ন প্রজাতির ওপর হুমকি বেড়েই চলেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে বেআইনিভাবে গাছ এবং এর বীজ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার করা, ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করা এবং অপরিকল্পিত ও অস্থিতিশীল চাষাবাদ ক্যাকটাসের বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা প্রজাতিগুলোর মধ্যে ৪৭ শতাংশের জন্য দায়ী। ৩১ শতাংশ হুমকির সম্মুখীন প্রজাতির কারণ ক্ষুদ্রব্যবসায়ীদের সংরক্ষণ নীতি। বাকি ২২ শতাংশের দায় বার্ষিক চাষাবাদ নীতির। আবাসন এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নে এর ব্যবহার, আকরিকের জন্য খনন এবং জলজ লালন-পালনের কারণে এগুলো টিকতে পারছেনা। বিশেষ করে চিংড়ি চাষ এর জন্য দায়ী। এরা জলের ভিতরে ক্যাকটাসের জন্মানোর জায়গা ধ্বংস করছে।
আইইউসিএন-এর মহাপরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন এ সম্পর্কে বলেন, “এটি অত্যন্ত হতাশাজনক। এই সমীক্ষা নিশ্চিত করেছে যে, বন্যপ্রাণী নিয়ে বেআইনি বাণিজ্য আমরা যা ধারণা করেছিলাম তার তুলনায় অনেক বেশি। এই অবাধ অবৈধ বাণিজ্য রোধ করার জন্য আমরা অতিসত্ত্বর ‘কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জার্ড স্পিসিস’ (CITES) নীতিমালাগুলো বাস্তবায়ন করব।”
ক্যাকটাস নতুন বিশ্বে অনুর্বর বাস্তুসংস্থানের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। এরা বিভিন্ন প্রাণীর সংকটাপন্ন অবস্থায় বিশেষভাবে অবদান রাখে। হরিণ, কাঠবিড়ালি, খরগোশ, এক প্রজাতির নেকড়ে, টার্কি, টিকটিকি, কচ্ছপ প্রভৃতি প্রাণীর খাদ্য ও জলের প্রধান উৎস বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস।
ক্যাকটাসের ফল এবং রসালো পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ কাণ্ড বিভিন্ন দেশের গ্রাম্য অঞ্চলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ’Opuntia ficus-indica’ যাকে ‘কণ্টকিত নাশপাতি’ বলা হয়। এটি মেক্সিকোতে একটি বিখ্যাত খাবার ‘নোপাল’ হিসেবে পরিচিত যাকে বীফ স্টেকের সাথে তুলনা করা হয়।
‘Ariocarpus kotschoubeyanus’ প্রদাহের ঔষধ হিসেবে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই প্রজাতিটি এখন বিলুপ্তপ্রায়।
হুমকির সম্মুখীন প্রজাতির মধ্যে ৮৬ শতাংশ যেগুলো চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হয় সেগুলো বন্য পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ইউরোপীয় এবং এশীয়রা ক্যাকটাসের অবৈধ বাণিজ্যের জন্য প্রধানত দায়ী। বন থেকে সংগৃহীত হওয়ায় এবং বিরল হওয়ায় এ সম্পর্কে তেমন একটা খোঁজখবর রাখা হয়না বলেই অবাধে এমন বাণিজ্য চলতে পারছে।
এজাতীয় তথ্য একরকম ধাক্কার মত বলেই মনে করেন আইইউসিএন-এর সহ-সভাপতি এবং ‘ ক্যাকটাস অ্যান্ড সাক্যুলেন্ট প্ল্যান্ট গ্রুপস’ -এর প্রধান গবেষক বারবারা গোশ। তিনি বলেন, ”আমরা ক্যাকটাসের প্রজাতির প্রতি এরকম ভয়ংকর হুমকি কখনো আশা করিনি। এদের বিলুপ্তি অনুর্বর অঞ্চলে খাদ্য, প্রাণীবৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থানের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।”
বারবারা গোশের কথার সূত্র ধরে উদাহরণ হিসেবে ‘Echinopsis pampana’ র কথা টানা যায়। এটি পেরুর পুনা মরুভূমির এন্ডেমিক উদ্ভিদ যেটি অবৈধভাবে আলংকারিক উদ্ভিদ বাণিজ্যের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এর ফলে এ প্রজাতির ৫০ শতাংশ উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটেছে সর্বশেষ ১৫ বছরে। ঐ এলাকার ভূমির ব্যাপক পরিবর্তনও ঘটেছে। বর্তমানে এই প্রজাতিকে বিপন্ন ঘোষণা করা হয়েছে।
ক্যাকটাস মূলত তাদের বৈচিত্র্য এবং অসাধারণ ফুলগুলোর জন্য পরিচিত। এদের কিছু প্রজাতি এন্ডেমিক এবং সেসব অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান এদেরকে ছাড়া কল্পনা করা অসম্ভব। যদিও এরা সেসব অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের অংশ তবুও এদেরকে অনেকসময়ই অত গুরুত্ব দেয়া হয়না। আপাতদৃষ্টিতে এর ব্যবহার তেমন নেই বলে মনে হলেও বাস্তবিকপক্ষে এর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য জীববৈচিত্র্য প্রধান ভূমিকা পালন করে। পরিবেশ এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আবশ্যক।
তথ্যসূত্র,
১. Simon & Schuster Guide to Cacti & Succulents by Mariella Pizzetti & Stanly Schuler
৩. www.iucn.org
৬. Bangladesh Cactus Society
লেখক;
শিক্ষার্থী,
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ (২য় বর্ষ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।