দুর্গন্ধ সহ্য করুন, বহেড়া'র আছে ঔষধি গুণ!

মো. রেজাউল করিম

ক্যাম্পাসে ই-বিল্ডিং এর কাছাকাছি কিছু দিন ধরেই কিসের যেন দুর্গন্ধ! উটকি দিয়ে বমি আসতে চায় অনেকের। দুর্গন্ধটা অনেকটা খোলা জায়গায় থাকা মনুষ্য বর্জ্যের গন্ধের মত। কয়েক সপ্তাহ ধরে বড় একটা জায়গা জুড়ে যেহেতু গন্ধটা আছে, ঘটনা নিশ্চয়ই ‘ছোট’ না! ওয়াশ রুমের বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন পাইপ-টাইপ ফেটে গেছে হয়তো! বাজি ধরে বলতে পারি, বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না, গন্ধটা আসলে একটা গাছের ফুলের!
11150347_913461855384769_2443357143798333531_n

তথ্যটা আমি জানতে পারি ক্যাম্পাসের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। “বিশ্বাস না হলে ফুল শুঁকে দেখ”- তার চ্যালেঞ্জ। ফুল শুঁকে দেখার প্রয়োজন পড়েনি (সাহসও হয়নি), গাছের কিছুটা কাছাকাছি যেতেই তাঁর কথা কড়ায় গন্ডায় বিশ্বাস করেছি।

এরপর থেকে আমিও পরিচিতদেরকে গন্ধের উৎস সম্পর্কে সাগ্রহে জ্ঞান দিয়ে আসছি। উৎস যে টয়লেট নয়, ফুল শোভিত বৃক্ষ- আমার এক বন্ধু সেটা বিশ্বাস করতে চাইছিল না। সে টং-এ বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল, আমি ফুলসহ গাছের একটা ছোট ডাল ভেঙ্গে হঠাৎ তার নাকের কাছে ধরলাম, একটুর জন্য বমি করেনি বেচারা।

বেশ লম্বা গাছ, গাছ ভর্তি অসংখ্য ছোট ছোট সাদা ফুল; ধবধবে সাদা না, সবুজাভ সাদা। রতনে রতন চেনে! দেখা গেল, মাছিরাও গাছটি চেনে। গাছ ভর্তি অসংখ্য মাছি; ফুলে, পাতায়, ডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। র‍্যাফ্লেজিয়া (rafflesia) ফুলের কথা মনে পড়লো, ফুলটা নাকি পঁচা মাংসের গন্ধ ছড়ায়। গন্ধ পেয়ে পোকামাকড়, মাছি, মরাখেকো পাখি উড়ে এসে জুড়ে বসে, তাদের গায়ে লেগে যায় ফুলের রেণু! পরাগায়ণের জন্য কত রকম কায়দা কানুন!

ক্যাম্পাসের এই উদ্ভট উৎকট গাছটির নাম কী? যে ভাই এই গাছটির খোঁজ দিয়েছিলেন তিনি নাম বলতে পারেননি। আরো অনেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁরাও জানেন না।

গাছটি নিয়ে কতজনের মনে কত উত্তেজনা। এই ফালতু গাছটা এখানে লাগানোর প্রয়োজনটা হলো কেন? ক্যাম্পাসের মত জায়গায় কোন বেআক্কেল এই কাজটি করেছে? ধরে যদি থাবড়ানো যেত! আমরা ছাত্ররা যদি গাছটি কেটে ফেলার জন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে লিখে দরখাস্ত দেই, তাহলে স্যাররা নিশ্চয়ই কেটে ফেলার ব্যবস্থা করবেন। এখন উদ্যোগ নিলেই হয়।

ই-বিল্ডিং এর সামনে দু’সারি টং দোকান আড়াআড়ি যেখানে এসে মিলেছে, গাছটা সেখানে। খালেক মামার টং-এর ঠিক পেছনের গাছটা! গাছটার পেছনে কিছুটা দূরে সি-বিল্ডিং। সেদিন টং-এর এক মামা বললেন, “গাছটা নিয়া অনেক সমস্যায় আছি। অনেকেই গন্ধে খাইতে পারে না। অন্য জায়গায় খাইতে যায়। ব্যবসায় লস হচ্ছে।”

আমি বললাম, “স্যারদের বলেন কেঁটে ফেলতে।”

মামা হেসে বললেন, “আমাদের বলতে হবে না, স্যাররা নিজেরাই কাঁটতে চাচ্ছে। সি বিল্ডিং-এর স্যারদের রুমে গন্ধ যায়। স্যাররা খোঁজ পেয়ে কাঁটতে চাচ্ছে। এক কর্মচারী খাইতে আসছিলো, তার কাছ থেকে জানলাম।”

আমার ছোট বোন ক্লাস সেভেনে পড়ে। মোবাইলে কথা বলার সময় ওকে এই গাছটার কথা বলেছিলাম। ও গাছটার নাম দিয়েছে, ‘পঁচা গাছ’। মোবাইলে কথা হলে জিজ্ঞেস করে, “পঁচা গাছটার কী অবস্থা? কেঁটে ফেলেছে, না আছে? পঁচা গাছটায় এখনও গন্ধ আছে? মাছিগুলা আছে? ফল ধরেছে গাছে?”

‘পঁচা গাছ’টার নাম জানতে পারলাম আজকে। গ্রামের মানুষজন গাছটি চিনতে পারে- ভাবনাটা সত্য হলো। স্থানীয় বয়স্ক এক লোককে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “এটার নাম ‘বয়রা’ গাছ। খুব দামী গাছ, ঔষধি গাছ। ফলের দাম চারশ-পাঁচশ টাকা কেজি!”

আমি মনে মনে বললাম, “হায়! হায়! এসব কী শুনছি! ”

তিনি আরো বললেন, “এ গাছের ঘ্রাণে অনেক উপকার…”

“ঘ্রাণ না গন্ধ বলেন চাচা।”

তিনি বললেন, “এ গাছের গন্ধে অনেক উপকার। নিম গাছের মত। গাছের বাতাসে শরীল ভালো থাকে। ‘বুক ভরে’ ফুলের গন্ধ নিলে অনেক অসুখ সেরে যায়।”

বুক ভরে? আমি গাছটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। গ্রামের মানুষজন কি অসুখ দূর করতে ‘বুক ভরে’ এই উৎকট গন্ধ নেয়!

স্কুল-কলেজে জীববিজ্ঞান বইতে ‘বহেড়া’ নামে এক ঔষধি গাছের নাম জেনেছিলাম। ‘বয়রা’ নামটা শোনার পর থেকেই মাথার ভেতরে ‘বহেড়া’ ‘বহেড়া’ করছিল। বয়স্ক লোকটার বলা ‘বয়রা’ গাছটিই কি সেই ‘বহেড়া’ গাছ! হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল- নামে মিল আছে, আবার দুটোই ঔষধি গাছ। গুগোল মামার কাছ থেকে জানতে পারলাম, হ্যাঁ, এটাই সেই বহেড়া গাছ! নেট থেকে গাছের পাতা, ফুল ও ফলের ছবি মিলিয়ে দেখলাম।
11152345_913461585384796_3059082337041242440_nবহেড়ার বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia bellirica (টারমিনালিয়া বেলেরিকা)।

আদি নিবাস ভারতবর্ষে। সনাতন ধর্মমতে, দেবরাজ ইন্দ্র অমৃতের সন্ধানে যখন সমুদ্র মন্থন করছিলেন, সেই সময় এক ফোঁটা অমৃত পৃথিবীতে পড়ে যায়। সেই অমৃতের ফোঁটা থেকেই বহেড়া বৃক্ষের জন্ম!

দবহেড়ার সংস্কৃত নাম- বিভীতক, ভিবিটাকা, অকসা; আরবি নাম- বালীলাজ,ফারসী নাম – বালীলা, ইংরেজি নাম- Beleric. বহেড়ার অনেক গুণ। গুগোলে সার্চ দিয়ে দেশি-বিদেশি যতগুলো ঔষধি গাছ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বা স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সাইট দেখলাম, নিউজ পোর্টালের ফিচার দেখলাম প্রায় সবগুলোতেই বহেড়ার গুণাগুণ একযোগে স্বীকার করা হয়েছে। বহেড়ার এত গুণ যে, তুলসী বা নিমের উপকারিতার কথা যদি লেখা হয়েছে দশ লাইন, তাহলে বহেড়ার উপকারিতার কথা লেখা আছে পনের লাইন। ফুলে দুর্গন্ধ থাকলে কী হবে, গুণ আছে অনেক! উনানি বা ভেষজ ঔষধের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী এবং প্রাচীন হচ্ছে- ত্রিফলা। এই ত্রিফলা বা তিনটি ফল হচ্ছে- আমলকি, হরিতকি, এবং বহেড়া। এরমধ্যে বহেড়া ফল সবচেয়ে দামি এবং দূষ্প্রাপ্য।

বহেড়ার বীজ, ফল, গাছের ছাল সবই ঔষধি, সবই মূল্যবান। হজমশক্তি বাড়াতে, শ্লেষ্মা নিরাময়ে, সর্দি-কাশি, আমাশয়, হাঁপানি থেকে মুক্তি পেতে, কৃমি নাশ করতে, ডায়রিয়া প্রতিকারে, পাইলস, অনিদ্রা রোগে, ফোলা কমাতে, চুল পাকা ও চুল পড়া প্রতিরোধে বহেড়ার বীজ, ফল, গাছের ছাল ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, বহেড়ার শাঁস যৌন শক্তি বর্দ্ধক, বীর্য বর্দ্ধক এবং দেহে তারুণ্য উদ্দীপক।

অতএব, মাননীয় স্পিকার, বহেড়ার ফুলে যতই দুর্গন্ধ থাকুক, এমন গুণবতী গাছটিকে কিছুতেই কাঁটা যাবে না!

এপ্রিল মাসের দিকে ফুল ফোঁটে। ফুল যতদিন গন্ধ ততদিন থাকে। ফুলগুলো ফলে পরিণত হলেই গন্ধ শেষ। সপ্তাহ দুই-তিনেকের মত ফুল থাকে। শেষের দিকে গন্ধের তীব্রতা বেশ কমে যায়, শুরুর দিকেই যা একটু সমস্যা। গন্ধের উৎস সম্পর্কে জানার আগে আমার বেশ অস্বস্তি হতো, টং-এ বসে খাবার সময় কিছুটা ঘিনঘিনে, কিছুটা অসুচি ভাব হতো। গন্ধটা যে ফুলের সেটা জানার পর আর হয় না। গন্ধ প্রকট হলে নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা অস্বস্তি হয়- ঐ পর্যন্তই। আমার বিশ্বাস এই লেখাটি পড়ার পর  আর কারো অসুচি অনুভূতি হবে না। খাবার সময় তারপরেও কারো সমস্যা হলে ‘বুক ভরে’ নিঃশ্বাস নিন আর বারবার অটোসাজেশন দিতে থাকুন- “নিঃশ্বাসের সাথে আপনি শুদ্ধ বাতাস গ্রহণ করছেন, যে বাতাস আপনাকে এনে দিবে সুস্বাস্থ্য, এনে দিবে তারুণ্য আর দেবে ভরা যৌবন!

কোন  ফুলেও যে এরকম গন্ধ হতে পারে গাছটা না থাকলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। জীবনে কত কিছুর জানার আছে! উদ্ভট উৎকট গন্ধের কারণেই না গাছটা চিনতে এত আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। ৩৬৫ দিনের মধ্যে অল্প কিছুদিন একটি গুণবতী গাছের জন্য কিছুটা ছাড় দেয়া কঠিন কিছু না। বহেড়া গাছের মত একটি ঔষধি গাছের নমুনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে থাকা দরকার। আমাদেরও গাছটি চেনা দরকার। আশা করি ছাত্র বা শিক্ষক কোন পক্ষই গাছটি কাঁটার জন্য আর আবেদন করবেন না। আর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে আবেদন এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে আলতো করে বের করে দিবেন।

আমার এই লেখাটি শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের একটি পঁচা গাছ ‘বহেড়া’র জীবনের জন্য।

বহেড়া তুমি দীর্ঘজীবী হও
আমরা আছি তোমার পাশে!

লেখক;
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics