সিলেটের হাওরগুলো মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে
হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী
প্রবাদ আছে ‘যেখানে পানি, সেখানেই মাছ’-কিন্তু কথাটি এখন ধীরে ধীরে অনেকটা মিথ্যায় পরিণত হতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ, জলমহালের ইজারাদার ও মত্স্য ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ইতোমধ্যে সিলেটের বহুস্থানে বহু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সিলেটে জলাশয়ের অভাব নেই। তুবুও মাছের ঘাটতি । মত্স্য কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মধ্যে সিলেট অঞ্চলে ৮০-৯০ প্রজাতির মাছ আর ১০-১৫ প্রজাতির চিংড়ি, কাকড়া ও কচ্ছপ পাওয়া যায়। “কিন্তু মনুষ্যসৃষ্টি ও পরিবেশগত কারণে দিন দিন মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে, উত্পাদন হরাস পাচ্ছে,” এরকম মন্তব্য করে মত্স্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এই সম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন ।
এখন ভরা বর্ষা। তারপরও এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী হাওর-বিলে মাছের দেখা মেলে না। মাছের বাজারও চড়া। আমদানিকৃত ও চাষের মাছ এখন ‘মাছ বাজারের’ অস্থিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এদিকে মত্স্য সপ্তাহ চলছে। আবার বিভিন্ন হাওরে নিষিদ্ধ মাছ ধরাও চলছে। লোকবল সংকটের কারণে মত্স্য বিভাগও সবসময় অভিযানে নামতে পারছে না। দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে টোকেন দিয়ে মাছ ধরা চলছে। এই বাণিজ্যে মেতেছে প্রভাবশালী একটি চক্র। এ কাজে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে প্রভাব শালী নেতাকর্মী ও প্রশাসনের কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে হাকালুকির বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এখানে প্রতিদিন চলছে অবৈধভাবে মাছ আহরণ । হাকালুকি হাওরের ২৩৮টি বিলের চিত্র ভয়াবহ। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী-বড়লেখা-কুলাউড়া ও সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ গোলাপগঞ্জ এই ৬টি উপজেলায় সমপৃক্ত মিঠাপানির বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। এলাকাবাসী জানান, সিন্ডিকেট তৈরি করে নির্বিঘ্নে মাছ আহরণ চলছে। জুড়ী উপজেলার শাহাপুর, জাঙ্গিরাই, নয়াগ্রাম ও খাগটেখা মৌজার কয়েকশ’ মানুষ হাওরে মাছ শিকারে ব্যস্ত ২৪ ঘন্টা। মাছের সাথে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাকালুকির জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব। হোগা (চাপিলা), ইছা, কাঁচকি ও তিতপুঁটি শিকারের নামে এসব মত্স্য শিকারি ও সিন্ডিকেট সদস্যরা শিকার করে নিচ্ছে সব ধরনের মাছ।
৩ শতাধিক বেড় জাল নিয়ে মাছ শিকার চলছে। এসব জালের মালিকরা বিত্তবান। মালিকরাই মূলত সৃষ্টি করেছে টোকেন সিস্টেম। টোকেন ছাড়া জাল দিয়ে মাছ ধরে ডাঙ্গায় উঠলেই বিপদ। গত মাসে এমন দুজন শিকারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জুড়ী উপজেলা মত্স্য অফিসে গিয়ে মুছলেকায় ছাড়া পায়।
শিকারিরা জানান, একেকটা জালের সঙ্গে ২০-৩০ জন করে শিকারি থাকে। ২শ’ হাত জালে থাকে ৫০ থেকে ৬০ জন। এসব জাল ৪শ’ থেকে ২ হাজার হাত লম্বা। সবচেয়ে ক্ষতিকারক জাল হচ্ছে তিতপুঁটি মারার কৌশলী জাল। একে বিষ জালও বলা হয়ে থাকে। এই জাল দিয়ে শিকারিরা ছোট ছোট মাছের পোনা ধরে। গলফা জাল দিয়ে শিকার করা হয় বড় বড় মাছ। তাছাড়া সব শ্রেণীর মাছ শিকারে রয়েছে বেড়জাল। শিকারিদের সঙ্গে জালের মালিকদের চুক্তি হলো সব খরচ বাদে জালের এক ভাগ, শিকারিদের ২ ভাগ। তাতে করেই শিকারিদের জন প্রতি ৮শ’- ১ হাজার টাকা দৈনিক আয় হয়। এর মধ্যে হাওর রক্ষা কমিটির ভাগ রয়েছে। সামছুল হক নামের এক ব্যক্তি হাওর রক্ষা কমিটির নামে চাঁদা উঠিয়ে থাকে শিকারিদের কাছ থেকে। হাকালুকি ছাড়াও অবৈধ মাছ ধরার মহোত্সব চলছে সিলেটের প্রতিটি বড় বড় হাওরে।
হাওরের দেশ বলে খ্যাত সুনামগঞ্জে কারেন্ট জাল, কোনা জাল আর বিল শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে হাওরের নানা প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত। অন্যদিকে জেলা মত্স্য অফিস বলছে, হাওরে দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে কার্যক্রম হাতে নিচ্ছেন তারা। এক সময় সুনামগঞ্জে ছিল মাছের অভয়াশ্রম। শহর ও গ্রামের হাটবাজারগুলোতে দেশীয় প্রজাতির মাছ ছিল অত্যন্ত সহজলভ্য। হাওর এলাকায় ধরা পড়া মাছ সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে এমনকি দেশের বাইরে সরবরাহ হত। দেশ-বিদেশে নানা প্রজাতির সুস্বাদু মাছের কদর ও সুনাম ছিল। কিন্তু নির্বিচারে পোনা মাছ নিধন, পানি সেচে জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে এলাকায় দিন দিন মাছের উত্পাদন কমে গেছে।
মত্স্য অফিস সূত্র জানায়, জেলার শতাধিক হাওরে গজার, রাগা চেং, কাজুলি, পাবদা, রানী মাছ, ভোলা, ঘোড়ামুইখ্যা, সরপুটি, কানি পাবদা, নামা চান্দা, চিতলসহ অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। এ কারণে এখন হাটবাজারে খোঁজে পাওয়া যায় না দেশীয় প্রজাতির মাছ। ধর্মপাশার জয়শ্রীবাজারের জেলে আহমদ মিয়া বলেন, ইজারা প্রথার কারণে হাওরে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ জেলা মত্স্য কর্মকর্তা সুলতান আহমদ দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির কথা স্বীকার করে জানান, কারেন্ট জাল, কোনা জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এরমধ্যে বেশক’টি জাল ধরা হয়েছে।
সিলেটের মত্স্য কর্মকর্তা শঙ্কর রঞ্জন দাস জানান, জলাশয়ে মত্স্য সম্পদ কোনো হরাস পাচ্ছে তার ১৯টি কারণ নির্ণয় করে পরিস্থিতি উন্নয়নে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে, জলমহল ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠুু নীতিমালার অভাব, অভয়াশ্রম ধ্বংস, জলাশয়ে অতিমাত্রায় মাছ আহরণ, কীটনাশকের ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট, পানি দূষণ, খাল-বিল শুকিয়ে মাছ আহরণ, জলমহল ভরাট, মত্স্য আইন অমান্য ইত্যাদি।
মত্স্য কর্মকর্তারা মনে করেন, মুক্ত জলাশয়ে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিক হচ্ছে উত্পাদনমুখী ব্যবস্থাপনা। তাই জলমহলগুলোকে সরকারি রাজস্ব আয়ের প্রধান খাতে পরিণত না করা। প্লাবন ভূমিকে পানি দূষণ থেকে রক্ষা করা। সরকারি খাস জলাশয়ে মাছের অভয়াশ্রম তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক (১৫/০৭/২০১৩)