সরলাক্ষির আবির্ভাব এবং বিবর্তন

শাওন চৌধুরী

যে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে এমন কোন অকৃত্রিম সৌন্দর্যের ভান্ডারযুক্ত প্রাণির নাম বলো, তাহলে কোনরকম চিন্তা ছাড়াই সবাই এক কথায় উত্তর দিবে ‘প্রজাপতি’। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে হাজারো সৌন্দর্যের ভান্ডার। আমরা জানি যে, বিভিন্ন পতংগের সাধারণত দুধরনের চোখ থাকে, যৌগিক চোখ এবং ওসেলাস বা আইস্পট। প্রজাপতির ও ঠিক তেমনি মাথার দুপাশে যৌগিক চোখ ও পাখাতে ওসেলি বা আইস্পট বা সরলাক্ষি দেখতে পাওয়া যায় (ওসেলাস হচ্ছে একবচন আর ওসেলি হচ্ছে বহুবচন)। প্রজাপতির দুডানাতেই এরকম এক বা একাধিক সরলাক্ষি দেখা যায়।

New Picture (3)

সম্প্রতি কয়েকজন গবেষক এসব সরলাক্ষির সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন! গবেষকদের মতে এসব ওসেলি বিবর্তনের না জানা অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারবে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ সালের এরিস্টটলের সেই বিখ্যাত প্রশ্নের কথা এখানে চলে আসে যে পৃথিবীতে কার আগে আবির্ভাব হয়েছে, ডিম নাকি মুরগী!! অনেক চিন্তাভাবনার পরে এরিস্টটল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ডিম ও মুরগী উভয়েই একই সময়ে পৃথিবীতে আসছে কিন্তু বর্তমানে আমাদের একথার সত্যতা কতোটুকু তা অনেকেরই জানা!

অনেকেই হয়তো ‘সিরিয়াল হোমোলোগাস’ এর সাথে পরিচিত নন কিন্তু যদি একটু চিন্তা করেন তাহলেই বিষয়টা অত্যন্ত সহজ হয়ে আপনার চোখে ধরা দিবে। হোমোলোগাস শব্দটির অর্থ হচ্ছে একই ধরণের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ সিরিয়াল হোমোলোগাস বলতে একই ধরণের বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তিকে বোঝায়। যেমন ধরুন যারা মেরুদণ্ডী প্রাণি তাদের সকলেরই পিঠে মেরুদন্ড আছে আর এগুলো একই ধরণের কতোগুলো হাড় নিয়ে গঠিত, একেই বলে সিরিয়াল হোমোলোগাস। এদের সকলেই একসাথে একই রকম কাজ সম্পাদন করে। মেরুদন্ডের মতো দাঁতের সারি, প্রজাপতির পাখাতে সরলাক্ষির সারি সবই এর উদাহরণ। বিভিন্ন গবেষক অনেক গবেষণার মাধ্যমে বের করেছেন যে এরা সংখ্যায় অনেক হলেও সবাই একসাথে একই রকম কাজ সম্পাদন করে যদিও বিজ্ঞানীদের কাছে এটা একটা কঠিন প্রশ্ন যে এদের উৎপত্তি কি করে হয়েছে!! এটা এভাবে চিন্তা করলেও হয় যে, কিভাবে এক ধরণের মুরগী থেকে নানান ধরণের মুরগীর সৃষ্টি হলো!

এই জটিল প্রশ্নের উত্তর প্রজাপতির পাখার সরলাক্ষির বিন্যাস থেকে সহজেই পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। নিমফ্যালিডি পরিবারের অধীনের প্রজাপতিগুলোর মধ্যে এসব আইস্পট অনেক বেশি সচরাচর দেখা যায়। এগুলো নানান ধরণের কাজ করে যেমন বিপরীত লিঙ্গের সদস্যকে চেনা অথবা অন্যান্য শিকারি প্রাণির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। এসব আইস্পটের আবির্ভাব সম্পর্কে দুই ধরণের ধারণা আছে, কেউ মনে করেন, একটা ওসেলাস থেকে এগুলোর উৎপত্তি আবার বাকিদের মতে বিভিন্ন রঙের গুচ্ছ থেকে এদের সৃষ্টি যা কিনা পরবর্তীতে আলাদা হয়ে গেছে।

‘সত্যি বলতে কি, এসব সরলাক্ষি সম্পর্কে ওপরে বর্ণিত দুটো তথ্যের কোনটিই সঠিক নয়।’ ওএসইউ কলেজ অব সায়েন্স এর ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলোজী বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল স্কোলার জেফরি অলিভার এমনটাই বলেন। তিনি আরো বলেন যে, ‘নানান তথ্যমতে কিছু ওসেলি গ্রুপ আকারে একই সময়ে আবির্ভাব হয়েছে এবং এরা একই সত্ত্বা হিসেবে কাজ করে।’

গবেষকদের মতে, জেনেটিক মিউটেশনের কারণেই এসব সরলাক্ষির আবির্ভাব ঘটেছে এবং এর কারণেই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে এসব সরলাক্ষির অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় (যদিও হার খুব কম) যা থেকে অনেকেই মনে করছেন যে এর সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক আছে কিনা! নতুনভাবে মিউটেশন না ঘটার পূর্ব পর্যন্ত এসব ওসেলির অবস্থানের সামান্যতম তারতম্যও ঘটে না।

অলিভার বলেন যে, ‘এসব সরলাক্ষি প্রধানত শিকারের হাত থেকে বাঁচতে অর্থাৎ প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্যই সব থেকে বেশি উপযোগী।’

প্রজাপতি যখন পাখা গুটিয়ে বসে থাকে তখন দূর থেকে শিকারি প্রাণি এসব ওসেলি দেখে বুঝতে পারেনা যে ঐখানে কোন কিছু আছে কিনা অর্থাৎ তখন এগুলো ক্যামোফ্লেজের কাজ করে কিন্তু কাছে আসলেই ঐসব আইস্পট দেখে শিকারি প্রাণিগুলো আগ্রহের সাথে আক্রমণ করে। মজার বিষয় হচ্ছে, এসব আইস্পটগুলো থাকে পাথার শেষভাগে যার কারণে ঐ আক্রমণ থেকে দেহের তুলনামূলক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো যেমন মাথা বা শরীর রক্ষা পায়।

কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কিভাবে যে ক্রমাগত মিউটেশনের ফলে এসব সরলাক্ষিগুলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম স্থানে জায়গা করে নিয়েছে এটা বিজ্ঞানীদের কাছে এক জটিল প্রশ্ন যা কিনা সম্পূর্ণ অন্যরকম কাজ করে-বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদেরকে সনাক্ত করতে সাহায্য করে।

‘যদি এই তত্ত্ব অনুসারে সিরিয়াল হোমোলোগাস ঘটে এবং মেরুদন্ডসহ শরীরের এমন অন্য অংশগুলোর দিকে নজর দেয়া যায়, তাহলে সহজেই বোঝা যাবে যে একটা মাত্র ছোট হাড় থেকেই মিউটেশনের ফলে ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব অঙ্গের আবির্ভাব হয়েছে যা কিনা প্রকৃতিতে টিকে থাকতে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। অলিভার আরো বলেন, ‘এগুলো কোথায় প্রথম আবির্ভাব হয়েছে কিংবা কোথায় অবস্থান করছে বা কি কাজ করছে তার চেয়ে বরং এরা পরবর্তীতে অন্য কোন অবস্থানে যাচ্ছে এবং যেসব সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কাজ করছে তার সাথে পূর্ববতী কাজের সামঞ্জস্য থাকা বা না থাকাটাই অধিক গুরুত্ববহ।’

জীবনের বিবর্তন কখনোই যে সহজ ছিলনা এটা এরিস্টটল এবং আরো অনেক দার্শনিকের চিন্তাভাবনা পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু এটা সহজেই বলা যায় যে, একটা মাত্র হাড় থেকে যেমন এতোগুলো হাড় সৃষ্টির মাধ্যমে মেরুদন্ডের আবির্ভাব ঘটেছে ঠিক তেমনি প্রজাপতির এসব আইস্পট বা ওসেলিরও অনেক পরিবর্তন ঘটবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics