সবুজের মশাল হাতে সবুজের সারথি : আল-গোর

সাইফুর রহমান সুমন

আমাদের এই বাসভূমি পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশ দিন দিন পরিবর্তিত হয়ে ধারণ করছে বিরূপ পরিবেশ। ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে পরিবেশের সহনশীলতার মাত্রা। মানুষ যেমন দায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য, তেমনি মানুষই আবার ভুমিকা রেখে চলেছে পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায়। পৃথিবীর নানা দেশের কিছু কৃতি সন্তানেরা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মত প্রভৃতি পরিবেশগত ইস্যু নিয়ে জনসচেতনতায় রেখে চলেছেন অগ্রগণ্য ভুমিকা। তাদের কেউ কেউ পরিবেশ নিয়ে করেছেন দুর্বার আন্দোলন। তেমনি একজন জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক নিয়ে আপনাদের সামনে আমাদের এই পরিবেশনা। পরিবেশ নায়কদের নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক পর্বে আজ আপনাদের সামনে যে ব্যাক্তিটিকে তুলে ধরব তিনি আমেরিকার প্রাক্তন উপ-রাষ্ট্রপতি ‘আল-গোর’। আমাদের উপস্থাপনের মাধ্যমে তুলে আনব জলবায়ু পরিবর্তন সচেতনতায় আল-গোরের বিশেষ ভুমিকা।algore

আল-গোর সম্পর্কে কিছু কথা

আল-গোর জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ৩১শে মার্চ আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি. শহরে। পুরো নাম আলবার্ট আর্নল্ড আল গোর। তিনি ছিলেন আল গোর সিনিয়রের দ্বিতীয় পুত্র।

শৈশব কাল কাটে ওয়াশিংটন ডি.সি. শহরে। স্কুল জীবন পার করেন ওয়াশিংটন শহরের সেন্ট এলাবামা স্কুলে। খেলাধুলায় ছিলেন সমান পারদর্শী, ছিলেন স্কুল ফুটবল দলের অধিনায়ক। খেলাধুলা সহ সব ধরনের কাজে ছিলেন দারুনভাবে আগ্রহী। ধিরে ধীরে আগ্রহী হয়ে উঠেন সরকার, রাজনীতি, সমাজ, আইনসহ বিভিন্ন ভারী বিষয়ের প্রতি। আর ছিল পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি প্রবল টান।

উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেন বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে। সম্মানের সহিত ডিগ্রি লাভ করেন সরকার বিষয়ে। হার্ভার্ডের মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অরজনের পরও মেটেনি বিদ্যার্জনের পিপাসা। পরবর্তীতে তিনি ভ্যান্ডারবিল্ট ল’ স্কুল থকে আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। প্রবেশ করেন রাজনীতির দুরন্ত মাঠে। চারদিকে ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন একজন সুশীল রাজনীতিবিদ, এডভোকেট ও লোকহিতৈষী হিসেবে। যেই ব্যক্তিটি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ক্লাইমেট চেইঞ্জ আন্দোলনের নায়ক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে, সেই আল-গোর কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয়ে খুব একটা পটু ছিলেন না। গনিতের প্রতিও ছিল কিছুটা ভীতি। যার হাত ধরে তিনি আসলেন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সচেতনতার দুনিয়ায়, তিনি আল_গোরের কলেজ প্রফেসর ‘রজার রেভেলে’। রজার রেভেলে ছিলেন একজন খ্যাতিমান সমুদ্র গবেষক এবং জলবায়ু পরিবর্তন তত্ত্ববিদ। তিনি আল-গোরের মধ্যে জাগিয়ে তোলেন সেই বোধ, উদ্ভুদ্ধ করেন পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে। চারদিকে যখন এহন পরিস্থিতি, তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবেশ বিষয়ক ইস্যু নিয়ে কাজ করার গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। ধীরে ধীরে তিনি দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন স্বীয় পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক কর্মকাণ্ডের পরিধির শাখা।

১৯৭৭-৮৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন মার্কিন টিনেসে অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেসম্যান। সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন মার্কিন সিনেটর হিসেবে(১৯৮৫-৯৩)। ছিলেন সাড়া জাগানো অ্যাপল ইনকরপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য। উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন গুগলের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের শাসনামলে আল-গোর আমেরিকার উপ-রাষ্ট্রপতি (১৯৯৩-২০০১) হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও শিক্ষা প্রদানের প্রয়াসে আমেরিকার বেশ কয়েকটি নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। al gor

আল-গোর ও জলবায়ু পরিবর্তন

আল-গোর নামটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন’ শব্দটি। কর্ম জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ব্যায় করেছেন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধের আন্দোলনের পিছনে। দাঁড়িয়ে ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। ইলেক্টোরাল ভোটে হেরে গেলেও তুমুলভাবে প্রচার চালিয়ে গেছেন জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিল পাশ, আইন প্রণয়ন ও এব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য। নিজেকে যুক্ত রেখেছেন বিভিন্ন ক্লাইমেট চেইঞ্জ সল্যুশন গ্রুপের সাথে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে আল-গোরের বৈশ্বিক প্রচারনাই তাঁর কর্ম পরিধির একটি বিশেষ দিক। নিজ টেলিভিশন চ্যানেল কারেন্ট টি.ভি. ইন্টারঅ্যাকটিভ টেলিভিশন সেবার জন্য পেয়েছেন অ্যামি অ্যাওয়ার্ড। তার সবচেয়ে বিখ্যাত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র “অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ”। এই ডকুমেন্টারিটি ২০০৭ সালে ‘সেরা ডকুমেন্টারি’ ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কার লাভ করে। ডকুমেন্টারিটিতে উঠে আসে পৃথিবীর বৈশ্বিক জলবায়ুর পূর্বাবস্থা থেকে বর্তমান দুরাবস্থা। দুই মেরুর বরফ কি হারে গলছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাই বা সমানুপাতিক হারে কিভাবে বাড়ছে তার একটি দারুণ গ্রাফিক্যাল চিত্র। প্রানী জগত এতে কিভাবে হুমকির মুখে রয়েছে তারও একটি চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে উক্ত ডকুমেন্টারিটিতে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা দিন দিন থার্মোমিটারের স্কেল ছাপিয়ে যাচ্ছে তাই পরিস্কার তুলে ধরা হয় “অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ” এর দর্শকদের সামনে।

পরিবেশের এই নেপথ্য নায়ক নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে নিজ খরচে বিভিন্ন স্কুল, কলেজে বিতরণ করেছেন পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক নানা রকমের শিক্ষণীয় ডকুমেন্ট সমুহ ও প্রচারণা পত্র। রাজনীতির মাঠে থাকলেও তিনি সব সময় পরিবেশ সচেতনতার বাণী সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। সারা বিশ্বব্যাপী তিনি কনফারেন্স ও সেমিনার এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব প্রচার করে গেছেন। তাঁর এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ স্বীকৃতি স্বরূপ ‘ইন্টারগভরমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ’ এর সাথে যুগ্মভাবে ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

দিকে দিকে জ্বলুক আলোক শিখা

পৃথিবীর নানা দেশের কৃতি সন্তানেরা তাদের বিভিন্ন সমাজ সেবা মুলক, পরিবেশ সচেতনতা মুলক কর্মকাণ্ডের জন্য লাভ করেছেন বিশ্ব স্বীকৃতি। তাদের কেউ কেউ সমাজ সেবার সাথে, কেউ অর্থনীতির কল্যাণে, কেউবা বিজ্ঞানের কল্যাণে সমগ্র জীবন ব্যাপি কাজ করে গেছেন। আমাদের এই বাসভূমি ও তাঁর পরিবেশ এবং জলবায়ু তেমনি আমাদের এমন একটি অঙ্গ হিসেবে পরিগনিত হয়েছে যার অল্প ক্ষতিও সমগ্র মানব জাতির জন্য অভিশাপ স্বরূপ। এই পরিবেশ এর টেকসই রক্ষার জন্য ও ভবিষ্যৎ জীবনের স্থায়ী বুনিয়াদ গঠনের লক্ষে যুগে যুগে যারা কাজ করে গেছেন আল-গোরের মত সেইসব মহা রথীদের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্দার্ঘ। এভাবে দিকে দিকে আলোক শিখা জ্বলুক প্রতিটি প্রাণে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics