"রুফটপ ফার্মিং" কংক্রিট জঙ্গলে সবুজের টুপি

ফারজানা হালিম নির্জন

ধরুন,আপনি ঢাকা শহরের এক বিরাট অ্যাপার্টমেন্টের কোনো ফ্ল্যাটে আছেন। বাড়ির আনাচে কানাচে সম্ভ্রান্ত কংক্রিটের স্তম্ভ আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনের শৈল্পিকতায় মুগ্ধ হতে হতে ক্লান্ত। হঠাৎ কিছু একটার শূণ্যতা অনুভব করলেন। কি হতে পারে সেটা! আপনার চোখ আরাম খুঁজছে। কোনো অজুহাত দাঁড় করিয়ে সোজা ছুটে গেলেন ছাদে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন,পুরো ছাদ মরুভূমির মত খা খা করছে। কোথাও কোনো সবুজ নেই। কেমন লাগবে,ভাবতে পারেন ? না,আমরা আসলেই সবুজ ছাড়া টিকে থাকার কল্পনাও করতে পারিনা। শহরের মানুষদের জন্য সবুজের সান্নিধ্য পাওয়া যেন একটু বেশিই কষ্টকর। তাই নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্যই মানব প্রজাতি যুগ যুগ ধরে ভেবে চলেছে,কিভাবে আমাদের অসম্পূর্ণতাগুলোকে আমরা সম্পূর্ণতায় রুপ দিতে পারি! তাই পথ-ঘাটের পাশাপাশি,বাড়ির ছাদটিকেও সহজেই করে নিতে পারি সবুজের ছায়াস্থল। দু’চারটি টবে ফুল গাছ কিংবা ফলের গাছও কিন্তু আমরা ছাদে শখ করে লাগিয়ে থাকি। তবে এই শখটাকেই আরো মজবুত করে দেখার সময় এখন আমাদের,এই গোটা পৃথিবীবাসীর।

বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে যখন হিমশিম খেতে হচ্ছে জীবনযাত্রা নিয়ে,তখন উদ্ভাবিত হলো অনন্য এক উপায়। ‘রুফটপ ফার্মিং’ অথবা ‘রুফটপ এগ্রিকালচার’ নামে যা পুরো পৃথিবীতে এখন পরিচিত। অর্থাৎ শহরে যেহেতু জায়গার অপ্রতুলতা,আর ছাদগুলো খালিই পড়ে থাকে,তাই ছাদগুলোকেও খুব সহজেই কাজে লাগানো যায়;সহজ কথায় চাষাবাদের জন্য ! হয়তো শুনতে একটু অবাক লাগছে,কিন্তু একবার ভাবুন তো,আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় শহরগুলো যখন অট্টালিকার ঘন জঙ্গলে ঢেকে যাচ্ছে,সেখানে সবুজের স্থান কতটুকু! আর অট্টালিকার ছাদ যতটুকু জায়গা ধারণ করে,সেখানে যদি অট্টালিকাটি না গড়ে উঠতো,তবে তা হতে পারতো কোনো কৃষকের জন্য সোনার জমি। সেখানে গড়ে উঠতে পারতো নানা ধরণের শাক-সবজি,ফলমূল অথবা নিছক ফুলের বাগান। যা আমাদের প্রাণিকূলের জন্য হতো এক বিরাট অর্জন। তবে কেন ঠিক সেই পরিমাণ ছাদটিকে আমরা মরুভূমির মতো ফেলে রাখবো! সেজন্যেই মানবকল্যাণে এবং পরিবেশের কল্যাণে রুফটপ ফার্মিং এর মতো চিন্তাপ্রকল্প এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। rooftop

রুফটপ ফার্মিং এর ঠিক গোড়ার দিকের ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ও জিগারেটস সাম্রাজ্য থেকে আসে। সেসব জনগোষ্টির মধ্যে প্রথম লক্ষ্য করা যায়,মাটি থেকে উপরে,অর্থাৎ দেয়ালের গোড়ায় গোড়ায় গাছ কিংবা ঝুলন্ত বাগানের অস্তিত্ত্ব। সময়ের পরিক্রমায়,সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে তা আজ রুফটপ ফার্মিং এর ধারণা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। এ তো গেলো ইতিহাসের কথা। এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক রুফটপ ফার্মিং এর উপকারি দিকগুলোর দিকে…

  • গ্রীণহাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে,তাতে ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায় হলো গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি। সবুজ গাছ বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষন করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে এক অনন্য হাতিয়ার। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাতাসে বৃদ্ধির সাথে সাথে পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। আর তাকে আমরা বলছি গ্লোবাল ওয়ার্মিং,যা একটি ভয়াবহ সমস্যা এখন পুরো পৃথিবী জুড়ে।এ ভাবে চলতে থাকলে উষ্ণ পৃথিবীতে ধীরে ধীরে প্রাণের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। আর তাই তাপমাত্রা সাম্যাবস্থায় রাখতে রুফটপ ফার্মিং এর কোনো বিকল্প হতে পারেনা।
  • গবেষণায় দেখা গেছে,ছাদের উপর সবুজের পরিমাণ বেশি থাকলে তা সেই ভবনের এর শক্তির ভারসাম্যে দারূন প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ সাধারণ ছাদের তুলনায় তা ৩০% পর্যন্ত শক্তির ব্যবহার হ্রাস করে থাকে। যার ফলে অনেকটুকু শক্তি সঞ্চিত রূপে রেখে দেয়া যায়।
  • রুফটপ ফার্মিং এর ফলে,ছাদের এই বৃহৎ সবুজ অংশ অতিবৃষ্টির অনেকটা পানি ধরে রাখতে সক্ষম।যার ফলে,শহরের নিষ্কাশন ব্যাবস্থা অনেক উন্নত হতে পারে।
  • রুফটপ ফার্মিং প্রকল্পের উৎপাদিত খাদ্যের যোগানে্র ফলে জীবাশ্ম জ্বালানীর খরচ অনেকখানি কমে যায়।
  • শহরের মানুষদের জন্য কর্মসংস্থানের স্থল হতে পারে রুফটপ ফার্মিং।
  • রুফটপ ফার্মিং কাছাকাছি রাখতে পারে কৃষক এবং ক্রেতা সম্প্রদায়কে। শহরের মানুষদের জন্য এটা তৈরী করে দিতে পারে বিশাল নেটওয়ার্ক।
  • মাটি এবং পানি কে বিষাক্ত কীটনাশক,উদ্ভিদনাশক,বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের কবল থেকে রক্ষা করতে রুওফটপ ফার্মিং এর তুলনা হয়না। ছাদের উপর চাষাবাদের ফলে আমাদের ভূপৃষ্ঠের মাটি এবং পানি তুলনামূলকভাবে অনেক সুরক্ষিত থাকতে পারে।
  • জীব-বৈচিত্র্যের ধারণা মানুষ প্রায় ভুলতে শুরু করেছে। সবুজের অস্তিত্ব যত বেশি বাড়বে জীব-বৈচিত্র্য তত বেশি পরিলক্ষিত হবে। আর তাই রুফটপ ফার্মিং হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। পরিবেশের সকল ধরণের প্রাণিকূলের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষায়,অর্থাৎ বাস্তুসংস্থানের জন্য রুফটপ ফার্মিং প্রকল্প দারুন প্রভাব রাখতে পারে।
  • অনেক অনেক উপকারীতার মধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে যা আমাদের চোখকে প্রাথমিকভাবে আরাম দেয়,তা হচ্ছে সৌন্দর্যতা। ছাদের উপর সবুজের আবাসস্থল,পাখিদের আনাগোনা,প্রজাপতিসহ নানা ধরণের আকর্ষনীয় কীট-পতঙ্গের ছুটোছুটি,এসবকিছুই হতে পারে,রুফটপ ফার্মিং এর সৌজন্যে।

নিউইয়র্কের মত আধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তির শহরের কথা অবশ্যই প্রথমে মাথায় আসবেনা,যদিনা আমরা এগ্রিকালচার নিয়ে চিন্তা করি! তবে অবিশ্বাস্য দিক হচ্ছে,গত পঁচ বছরের মধ্যে প্রায় আধ ডজন ফার্ম গড়ে উঠেছে পৃথিবীর এই বহুল আলোচিত ঘনবসতিপূর্ণ শহরটিতে। কেমন করে হলো? জায়গাই বা কোথায়! রুফটপ ফার্মিং এনে দিয়েছে এই বিরাট সাফল্য। শুধু নিউইয়র্কই নয়,টোকিও,সিঙ্গাপুর,বার্লিনের মত শহরগুলোতেও একই ভাবে গড়ে উঠছে সবুজের বাজার।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষকদের মতে,২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৭০% এলাকা থাকবে শহর এলাকার অধীনে। আর এরকম পরিস্থিতিতে রুফটপ ফার্মিং এর প্রসার ঘটানো নিশ্চয়ই কোনো অদ্ভুত চিন্তার সমকক্ষ হতে পারেনা !

 ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে,পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতো এগিয়ে যাচ্ছে,আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা তাহলে কী ? এবার তবে দেখা যাক।

পৃথিবীর জায়গার তুলনায় অধিক ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে উপরের দিকে থাকা,আমাদের ঢাকা শহরের কথাই ধরা যাক। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন,গত তিন বছর যাবৎ তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে,ঢাকা শহরের বর্তমান সময়ে প্রায় ৩.৫ লাখ জায়গা বরাদ্দ আছে,বাড়িঘরের জন্য ।যার মধ্যে প্রায় অধিকাংশই অট্টালিকা। এসব অট্টালিকার মোট ছাদের পরিমাণ হিসেব করে দেখা গেছে,যার সবগুলো মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার বিঘার(১ বিঘা=৩৩ডেসিমেল) সমপরিমাণ জায়গা দখল করে আছে। অর্থাৎ ৩০ হাজার বিঘা্র সমপরিমাণ জমি আমরা ব্যবহার না করে শুধু শুধু ফেলে রেখেছি !  সরকারী এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের মতে,কেবল মাত্র ৬ হাজার বাড়ির ছাদে সবুজের বাগান রয়েছে,হয়তোবা তার অধিংকশই দেখা যাবে নিছক দু’চারটি ফুলের টবের জন্যও তালিকায় স্থান পেয়েছে।

সবকিছু বিবেচনায় রেখে,পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা চিন্তা করে,আলাদা করে হয়তো আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া যাক,এবার তবে আমাদের প্রধান করণীয় কাজ কী ? খোঁজ করতে থাকুন নিজের মনেই,উত্তর পেয়ে যাবেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics