রাইট তিমির মৃত্যু রহস্য; ধাঁধার সমাধান হবে কি ??

আরিফুর রহমান মিনার

তিমির এই প্রজাতির নাম “রাইট তিমি” পৃথিবী জুড়ে উত্তর আর দক্ষিণ গোলার্ধের নীলজলের সবচেয়ে বড় প্রজাতি গুলোর মধ্যে এটিও অন্যতম। এটি পরিচিত তাদের বৃহৎ আকৃতি আর বিপুল পরিমাণ প্রানিজ তেলের উৎসের জন্য। কিন্তু সম্প্রতি, এই শত শত রাইট তিমি শাবকদের ব্যাপক রহস্যময় মৃত্যুহার বৃদ্ধি দক্ষিণের বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।আশ্চর্যজনকভাবে, বিপুল সংখ্যক রাইট তিমি শাবককে আর্জেন্টিনার উপকূলে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, যা বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ দের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।সামগ্রিকভাবে, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের রাইট তিমিরা তাদের উত্তর গোলার্ধের বিপন্ন জাতভাইদের তুলনায় বরাবরই অনেক ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনার ভালদেস উপদ্বীপের রাইট তিমির একটি দলের জন্য ভাগ্যটা ততোটা সুপ্রসন্ন হয়নি ।

timi 1

‘মেরিন ইকোলজি প্রোগ্রেস সিরিজ’ নামক এক জার্নালে চলতি মাসে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভালদেস উপদ্বীপে শ’খানেক তিমির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৩০টি রাইট তিমির মৃত্যু হয়েছে। timi 3

কিন্তু এ সকল মৃত্যুর ৭৭% ঘটেছে কেবল ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এবং সাম্প্রতিক সময়ে সে সকল মৃত্যুর ৮৯% হয়েছে কেবলমাত্র তিমি শাবক গুলোর। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এসব মৃত্যুরহস্য উৎঘাটনের জন্য। পর্যবেক্ষণে, খাদ্য ঘাটতিই মূলত বিগত বছরগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ মৃত্যুহার বৃদ্ধির জন্য সম্ভবত কিছুটা দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র এই কারণটি একমাত্র কারণ, সেটি মানতে নারাজ। তাদের মতে আরো কোন কারণ আছে, যা তাদের প্রচেষ্টাকে ঘটনার আরো গভীরে যেতে বাধ্য করেছে।

প্রচলিত কারণঃ

আন্তর্জাতিক তিমিশিকার সংস্থার আয়োজনে ২০১০ সালে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ও পশুচিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । যেখানে বক্তারা তিমিদের এই রহস্যময় মৃত্যুর ব্যাপারে সম্ভাব্য ৩টি ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। তাদের মতে- খাদ্য স্বল্পতা, রোগজীবাণু অথবা ক্ষতিকারক সামুদ্রিক শৈবাল থেকে উদ্ভূত ডোমিক এসিড বা সাক্সিটক্সিন’ই মূলত এই মৃত্যুর কারণ;যা ক্ষতিকারক অ্যালজি থেকে তৈরি হয়।

প্রধান গবেষণা লেখক রওনট্রি’র মতে তাদের নানবিধ গবেষণার মাধ্যমে উপরোক্ত বক্তব্য সত্য প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত, গবেষক এবং পশু চিকিৎসকরা শত শত মৃত তিমি শাবক থেকে নেয়া নমুনায় তাদের মৃত্যুর কোন স্বাভাবিক কারণ খুঁজে পাননি ।
রওনট্রি র মতে-“খুব কমসংখ্যক তিমিশাবকের দেহে রোগের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া গেছে অন্যদিকে বাকিদের শরীরেও টক্সিনের পরিমাণ অনেক নিম্ন মাত্রায়ই ছিল। যদিও তারা কি পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করেছিল এটা নির্ধারণ করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য”।

গবেষকরা এসব মৃত শাবকের ব্লাবার নামক অংশের গভীরতাও ও যাচাই করে দেখেন, এজন্য যে, তারা পর্যাপ্ত খাবার পেয়েছিল কিনা। তারা এদের শরীরে পুষ্টি ঘাটতির কোন লক্ষন পাওয়া যায় কিনা সেটিও যাচাই করে দেখেন। এই মৃত্যু যেমন বিজ্ঞানীদের একই সময়ে বিভ্রান্ত করেছিল, অন্যদিকে কি ঘটছে সেটা বুঝতেও সাহায্য করেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিমিশাবকেরা জন্মের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য বছরে তারা মে- ডিসেম্বরে(প্রসব মৌসুম) হয়তো মারা যেতো। এটি এটাই প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র একটি কারণে নয়, বরং একাধিক কারনই হয়তো “এই উচ্চ মৃত্যুহারের” জন্য দায়ী।

রওনট্রি বলেন “কিন্তু মৃত্যুহারের সময়সীমা হয়তো আমাদের কিছু ধারণা দিতে পারে যে কেন তারা মারা যায়”।

এই ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, “যখন মা তিমিরা ক্রিল (krill) এবং কপিপোডস (copepods) খাওয়া শুরু করে তখন এসব শৈবাল থেকে টক্সিন নির্গত হয় যা স্তন্যপানের মাধ্যমে শাবকগুলোতে ছড়িয়ে পরে। ফলাফল সরূপ তারা মৃত্যুবরণ করে”।

উত্তর আটলান্টিকে রাইট তিমির মোটসংখ্যার পর্যালোচনা ইঙ্গিত দেয় যে ক্ষতিকর শৈবাল গলধঃকরণের মাধ্যমে তাদের শরীরে টক্সিন ছড়িয়ে পরে। এটা মূলত আসে  ক্রিল(krill) এবং কপিপোডস (copepods) থেকে, যারা মূলত শৈবালভোজী এবং এসব মাছ গলাধঃকরণের মাধ্যমে পরবর্তীতে এসব টক্সিন তিমিতে ছড়িয়ে পরে। রওনট্রি র মতে প্রাপ্তবয়স্করা এটা মোকাবেলা করতে সক্ষম হলেও বাচ্চাগুলোর জন্য এই টক্সিন খুবই বিষাক্ত। তাই তারা মৃত্যুবরণ করে। timi 4

 পাখিদের দোষারোপ করবেন?

আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে- যা কিনা রওনট্রি সাওসালিটো’তে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পশু চিকিৎসক সম্মেলনে নিজেও সমর্থন দিয়েছেন এবং বিশদ আলোচনাও করেছেন। তা হচ্ছে কেপ গালস(Kelp gulls) নামক পাখিদের আক্রমণ। এরা এক প্রকার সামুদ্রিক গাংচিল। এসব গাংচিল আকারে অনেক বড় হয়ে থাকে।এরা তাদের খাদ্য হিসাবে তিমি মাছের পিঠের চামড়া খেয়ে থাকে। তারা খুবলে খুবলে তিমিশাবকগুলোর পিঠ থেকে চামড়া খায় যার ফলে এদের পিঠে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং তাদের এই আক্রমণ প্রসব মৌসুমে ক্রমাগত চলতেই থাকে।

কিছু উচ্চাভিলাষী পাখি ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে এই কৌশল শুরু করেছিল যা পরবর্তীতে সমস্ত পেনিনসুলা উপদ্বীপের অন্যান্য গাংচিলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

মা তিমিগুলো পাখিদের এই তীক্ষ্ণশিকার প্রক্রিয়ার মনোযোগ এড়াতে পারে, কিন্তু বাস্তবে শাবকগুলো তা পারেনা। তাই অধিকাংশ তিমিশাবক তাদের পিঠে এই আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়ায়।

প্রাণী বাস্তুতন্ত্রবিদদের মতে এটা খুবই সম্ভব যে পাখিদের এরকম আক্রমণের কারণেও রাইট তিমি শাবক মারা পড়ছে পেনিনসুলা ভালদেস উপকূলে। কিন্তু সমস্যা শুধুমাত্র একটাই তা হলো, কেন এসব রাইট তিমি তাদের উত্তর উপকূলের ভাইদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণেই মারা পড়ছে ?? এই প্রশ্নের সমাধান কি আদৌ জানা যাবে??timi 2

খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ

রওনট্রি এবং তার সহকর্মীরা এই তিমিদের ভোজন প্রক্রিয়া খুঁজেছেন।.কিছু প্রমাণ রয়েছে যে এন্টারটিক ক্রিল Antarctic krill ( Euphasia superba ) এর কারণেই হয়তো তিমির মৃত্যু বৃদ্ধি পেতে পারে।
মা রাইট তিমি প্রসবের পূর্বে খাদ্য হিসাবে এসব krill তাদের চর্বিতে এ মজুদ করে রাখে। প্রসবকালীন সময়ে কয়েকমাস মা তিমি না খেয়ে থাকে। যদি চর্বি পরিপূর্ণ না হয় তবে তারা হয়তো তাদের শাবক গুলোকে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে পারবেনা।

রওনট্রি এর মতে-‘ তাদের বিলিন হয়ে যাবার পেছনে তাদের খাদ্যাভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ। যদি মা তিমিগুলো শুধু দক্ষিন গোলার্ধেই খাদ্য গ্রহন করে থাকে, তবে সেই খাদ্যের একটি অনন্য বৈশিষ্ট থাকবে’।

যদি গবেষকরা পেনিনসুলা ভালদেস রাইট তিমির মৃত্যু এবং ক্রিল সল্পতার মাঝে একটি সম্পর্ক দেখাতে সমর্থ হোন, তবেই বোঝা যাবে কোন কারণে এত তিমি শাবক মারা যাচ্ছে।

 প্রতীক্ষায় পালাঃ

খুব তাড়াহুড়া করে বলা সম্ভব নয় যে এই মৃত্যু তিমির সম্ভাব্য সংখ্যাকে কিভাবে প্রভাবিত করবে। তবে ভালো কিছু যে বলা যাবেনা এটাই স্বাভাবিক। গত বছর, গবেষকরা ভালদেস উপদ্বীপে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাইট তিমির জনসংখ্যার ১১৬ টি নথিভুক্ত করেছেন যা দক্ষিণ অ্যাটল্যান্টিকের পশ্চিমাঞ্চলের সমগ্র তিমির মাত্র ৩ শতাংশ !!

দক্ষিণের একটি স্ত্রী রাইট তিমি সন্তান প্রসবের জন্য তৈরি হয় ৯ বছর বয়সে। ২০০৫ সালে যেসব তিমি জন্ম নিয়েছিল তারা সন্তান ধারণে সক্ষম হবে ২০১৪ সালে। তাদের প্রসবকাল এক বছর স্থায়ী হয়। এরপর একবছর সময় লাগে বাচ্চাগুলো লালন পালনে, আর পরের বছর মা আবার পুনরায় প্রসবের প্রস্তুতি সরূপ তার চর্বির স্তরকে খাদ্যপূর্ণ করতে। সুতরাং আরও তিন বছর গবেষকদের অপেক্ষায় থাকতে হবে এই মৃত্যুরহস্য সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেতে যে, কি পরিমাণ ভালদেস রাইট তিমি জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেই সাথে আমরাও এই রহস্য উৎঘাটনের অপেক্ষায় রইলাম……

সূত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অবলম্বনে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics