মহানগরী ঢাকায় সর্বাবস্থায় সহনীয় মাত্রার দেড় থেকে দুইগুণ শব্দ বিরাজ করছে

বিভিন্ন কারণে উচ্চ শব্দের উৎসসমূহ একদিকে যেমন বাড়ছে একইসাথে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় শব্দ দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে বিরাজ করছে। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে পবা ঢাকার বিভিন্ন স্থানের শব্দের মাত্রা নিরুপণ ও পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় স্থান ভেদে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে উচ্চচাপ, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মনসংযোগ কমে যাওয়া, মাথা ব্যাথা ও মাথা ধরা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিবোধ এমনকি অস্বাভাবিক আচরণ করার মত মনোদৈহিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও এর কোন প্রয়োগ নেই বললেই চলে। শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি লাঘবে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, স্থানীয় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। আজ ০৩ ডিসেম্বর ২০১৩, মঙ্গলবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে ঢাকার বিভিন্ন স্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে উক্ত তথ্য জানানো হয়।

জরিপকৃত ফলাফল পর্যালোচনা

জরিপকৃত ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়,
নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৫-৯৭ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশী।
আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৬-৮৭ ডেসিবেল যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণেরও বেশী।
মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৩-১০২ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণেরও বেশী।
বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭১-১০৭ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশী।
জরিপ হতে প্রাপ্ত ফলাফল মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এভাবে শব্দ দূষণ চলতে থাকলে শিশুদের মধ্যে বধিরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও বিকার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে।

ঢাকা মহানগরীতে শব্দ দূষণ নিয়ে পবা'র সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন পবা নেতৃবৃন্দ
ঢাকা মহানগরীতে শব্দ দূষণ নিয়ে পবা’র সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন পবা নেতৃবৃন্দ

পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়নার সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পবার কো-অর্ডিনেটর আতিক মোরশেদ। উপস্থিত ছিলেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, আসলাম খান, পবার নির্বাহী সদস্য নাহিদ নাসরিন, শামীম খান টিটো, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, পরিবেশ সাং¯কৃতিক মঞ্চের পরিচালক মিজান শরীফ খোকা, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের সিনিয়র প্রজেক্ট অফিসার নাজনীন কবির, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক প্রমুখ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘœ ঘটায়। এছাড়াও শ্রবণশক্তি কমে আসে, বধির হওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়, মাথা ব্যথা, বদহজম, অনিদ্রা, মনসংযোগ কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিবোধ, এমনকি অস্বাভাবিক আচরণ করার মত মনোদৈহিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কন্ঠনালীর প্রদাহ, আলসার, মস্তিকের রোগও হতে পারে। হঠাৎ খুব জোর শব্দ যেমন যানবাহনের তীব্র হর্ণ বা পটকা ফাটার আওয়াজ মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রচন্ড চাপ দেয়। এধরনের শব্দের প্রভাবে সাময়িকভাবে রক্তপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়, রক্তনালী সংকুচিত হয়, রক্তে কোলেষ্টেরলের মাএা বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ণ মোটরযানের চালককে বেপরোয়া ও দ্রুত গতিতে যান চালাতে উৎসাহিত করে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।

শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায়, ২০০৬ -এ হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা “নীরব এলাকা” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ণ বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসমূহ নিজ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক, বা শিল্প এলাকাসমূহ চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করবে। এই বিধিমালার বিধান লংঘন অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। কোন ব্যক্তি নির্ধারিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ১ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডণীয় হবেন।

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান উপায়
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মোটরযান মালিক ও ড্রাইভারদের উচ্চ শব্দসৃষ্টিকারী হর্ন ব্যবহার না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা, নীরব এলাকায় হর্ণ না বাজানো ও অন্যান্য এলাকায় অপ্রয়োজনে হর্ণ না বাজানোর জন্য মোটরযান ড্রাইভারদের উদ্বুদ্ধ করা, যানবাহন নিয়মিত মেরামত করা, লাউড স্পীকারের ব্যবহারে সচেতন হওয়া, অডিও ক্যাসেটের দোকানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো নিয়ন্ত্রণ করা, কলকারখানায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন, উচ্চ শব্দের হর্ণ আমদানী বন্ধ করা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প বা মিশ্র এলাকা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, সর্বোপরি সকলের সরকারী বিধিবিধান মেনে চলা।

ঢাকা মহানগরীতে শব্দ দূষণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে প্রকাশিত “পবা” এর প্রতিবেদনটি পেতে এখানে ক্লিক করুন।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics