পলিথিন নিষিদ্ধের আইন বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেই

প্রতি বছর ৩রা জুলাই আন্তর্জাতিক প্লাষ্টিক মুক্ত দিবস হিসেবে ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে পলিথিন ও পলিথিনজাত দ্রব্যসামগ্রীর ব্যাপক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অথচ আইনানুসারে সকল প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ এর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরন, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ বিতরন বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ রয়েছে । পলিথিন নিষিদ্ধের আইন বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক প্লাষ্টিক ব্যাগ মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে আজ ০৩ জুলাই ২০১৪ বৃহস্পতিবার, সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

বক্তারা বলেন, পলিথিনে মোড়ানো গরম খাবার গ্রহণ করলে ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করা হলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা মাছ ও মাংস দ্রুত পঁচনে সহায়তা করে; পিভিসি এবং অন্যান্য প্লাষ্টিক জাতীয় আবর্জনা ৭০০ সে. তাপমাত্রার নিচে পোড়ালে ডাইঅক্সিন জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় যা জন্মগত ত্রুটি, চর্মরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি মারাত্মক রোগের জন্য দায়ী; উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সীসা ও ক্যাডনিয়াম যার সংম্পর্শে শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও চর্র্মপ্রদাহের সৃষ্টি হয়; ওভেনপ্রুফ প্লাষ্টিক কনটেইনার খাবার গরম করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে খাবারে ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সীসা মিশে যায় যার ফলে মরাত্মক রোগের সংক্রমন ঘটতে পারে; পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়, এমনকি ডায়রিয়া ও আমাশয় ছড়াতে পারে এ ব্যাকটেরিয়া থেকে।

পলিথিন বা পলিইথিলিন হল এমন একটা রাসায়নিক পদার্থ যা ইথিলিন পলিমার (সমরুপী- হাইড্রো কার্বনের চেইন) সমন্বয়ে তৈরী। পলিথিন ব্যাগ প্যাকেজিং সামগ্রী প্রস্তুুত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি অপচনশীল পদার্থ। একটি পলিথিন ব্যাগ প্রকৃতিতে মিশে যেতে সময় লাগে কয়েকশ’ বছর। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে প্রতিদিন এক কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। পলিথিন অপচনশীল বলে দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যালোক, পানি এবং অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করে; পঁচে না বলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায়, উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের বিস্তারে বাধা সৃষ্টি করে; পানিরোধক বৈশিষ্ট্য ও উপযুক্ত স্থানে না ফেলার কারণে সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা।DSC_4953

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ৬ক ধারার বিধানাবলী লংঘন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০১০ সনের ৫০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ১৫ (১) ধারায় বর্ণিত টেবিলের ৪নং ক্রমিকে উল্লেখিত দন্ড আরোপণীয় হবে। ধারা ৬ক এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনক্রমে বর্ণিত সামগ্রী (ক) উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ -এ প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক দুই বছর কারাদন্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড; পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন দুই বছর, অনধিক দশ বছর কারাদন্ড বা অন্যূন দুই লক্ষ টাকা, অনধিক দশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং (খ) বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার -এ অনধিক এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ (২০০২ সনের ১০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ২(খ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পলিথিন শপিং ব্যাগ সংক্রান্ত অপরাধসমূহের ব্যাপাওে অনুসন্ধান, কোন স্থানে প্রবেশ, কোন কিছু আটক, আনুষ্ঠানিক তদন্ত ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রয়োজনবোধে পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতে পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ (২০০২ সনের ১০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) অনুযায়ী মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় হতে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটন বহিভর্’তএলাকায় এস আই/সমপর্যায় হতে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাগণকে ০৪ মে ২০০২ তারিখের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উক্ত আইনে সংজ্ঞায়িত “পরিদর্শক” এর ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীর কারখানা রয়েছে। এগুলোর বেশীর ভাগই পুরানো ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর ও টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। এছাড়া চট্রগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে পলিথিন কারখানা। পলিথিন বাজারজাতকরণে পরিবহন সিন্ডিকেট নামে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। ‘জরুরী রফতানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। প্যাকেজিংয়ের ছাড়পত্র নিয়ে পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরী করে বাজারজাত করা হচ্ছে।

প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান বলেন, বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ৫০০(পাঁচ শত) বিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে, যা প্রতি মিনিটে ১(এক) মিলিয়ন । ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সমুদ্র সৈকত, লেক এবং নদীতে বছরে ৮(আট) বিলিয়নেরও বেশী পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও শহরের গ্রোসারী মার্কেট এবং শপিং মলে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে সেখানে বর্তমানে প্রায় ১০০(এক শত) মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে, যা আগামী ৫ বছরে ৫০ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এ চাহিদার শতকরা মাত্র তিন থেকে পাঁচ ভাগ রফতানি করছে। শুধুমাত্র আমেরিকায় পাটের ব্যাগ রফতানি করে বছরে ১ (এক) বিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। পলিথিন নিষিদ্ধ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে, পাটের ব্যবহার বাড়বে, মাঠ পর্যায়ে কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাটের ব্যাগ আমেরিকায় রফতানির উদ্যোগ নেয়া হলে রফতানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষক পাট চাষে উৎসাহিত হবে এবং পাটের ন্যায্য দাম পাবে। বাংলাদেশ সোনালী আঁশ পাটের ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, এসডোর গবেষণা সহকারী মো: কাউসার উদ্দিন মারুফ, পবার সম্পাদক এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক, বাংলাদেশ পীস মুভমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, সার্চ স্কেটিং ক্লাবের চেয়ারম্যান আরশাদ আলম প্রমুখ।

মানববন্ধন থেকে নিম্নোক্ত দাবীসমূহ উথাপন করা হয়-

বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ইত্যাদি সহজলভ্য করা।
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ইত্যাদি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামালের উপর উচ্চ হারে করারোপ করা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics