পরিবেশ ও বনের এই হাল করলো কে ??

আহমদ মমতাজ

পাহাড়-বনভূমি, নদী-সমুদ্র, চরাঞ্চল ও সমতল ভূমিবেষ্টিত চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি চট্টগ্রামকে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা। বিপুল প্রাকৃতিক বৈভব, হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিপুল ঐশ্বর্যপূর্ণ চট্টগ্রামের রূপে মুগ্ধ বিদেশি পর্যটক, ভূগোলবিদ, সাহিত্যিক, শাসক-সেনাপতি, ব্যবসায়ী, দূত ও প্রকৃতিপ্রেমিরা যুগে যুগে চট্টগ্রামকে ভালবেসে আখ্যায়িত করেছেন অন্তত ৪০টি নামে। এ সমস্ত নাম কতই না শ্রুতিমধুর, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও অর্থবহ। সেই আবহমান চট্টগ্রামের বর্তমান হাল দেখে দেশপ্রেমিক ও প্রকৃতিপ্রেমি নাগরিকদের মন আজ হাহাকার করে ওঠে; চট্টগ্রামকে কি আমরা তার লাখো-কোটি বছরের ঐশ্বর্য ও অমূল্য সাজ-সজ্জা নিরাভরণ করে চলেছি? পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও চট্টগ্রাম শহর এবং আশ-পাশে যে পাহাড় আর বনাঞ্চল ছিল বর্তমানে তার অনেকটাই নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে! বিগত বছরগুলোতে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ খুলশি, বাঘঘোনা, কুসুমবাগ, চশমা হিল, বায়েজিদ বোস্তামী, পলিটেকনিক এরিয়া, জালালাবাদ, ফয়েস লেক, কৈবল্যধাম, ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট এলাকায় অনেক পাহাড় বিলীন হয়ে গেছে। শুধু চট্টগ্রাম শহর কেন কক্সবাজারের সমুদ্র সংলগ্ন ঝাউবাগান কেটে প্রায় সাবাড়, আনোয়ারার পারকি, মহেশখালি-কুতুবদিয়ার সৃজিত বন-বৃক্ষ, মীরসরাই-সীতাকুণ্ডের সমুদ্র ঘেঁষে তৈরি বনাঞ্চল নির্বিচারে কেটে শেষ করে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে, ফলে একদিকে মানুষের জীবন-অস্তিত্ব যেমন হুমকির সম্মুখীন, তেমনি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট ও প্রাণীজগতের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। foys lake

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা করবে কে? কে বা কারা এই হাল করেছে? দেখভাল করছে আস্ত একটি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর-বিভাগীয়, জেলা এবং তৃণমূল পর্যায়ে কার্যালয়। দায়িত্বরত আছেন পূর্ণ মন্ত্রী, মহাপরিচালকসহ হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। যুগ যুগ ধরে সঠিকভাবে বন ও পরিবেশের সুরক্ষা থাকলেও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ঘটেছে ব্যতিক্রম। খোদ বনবিভাগের লোকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় চোখের সামনেই গত দুই/তিন দশকে বন-পাহাড় ও বৃক্ষরাজি নিশ্চিহ্ন। বিভিন্ন পদ-পদবীর কর্মচারীর ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদের সরেজমিনে অনুসন্ধান চালালেই এর সত্যতা মিলবে।

এযাবত্ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের কয়েকজনই চট্টগ্রামের অধিবাসী। বর্তমান সময়ে এই দুই বিভাগের দুর্নীতি, অনিয়ম ও খামখেয়ালী বেড়েছে বৈ কমেনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। মন্ত্রী স্বয়ং দুই বছর আগে যে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছিলেন, সে পাহাড়টিই নিশ্চিহ্ন করে তৈরি হয়েছে ভবন। parky beach

মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বরত লোকদের অসতর্কতা ও উদাসীনতার ফলে বিগত বছরগুলোতে দেশের বন ও পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে। অথচ চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও দেশে মোট বনভূমি ছিল প্রায় ১৭ ভাগ। আজ তা কমতে কমতে সাত-আট ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়-পর্বতগুলো একটা একটা করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা, শিল্পাঞ্চল প্রভৃতি। সীতাকুন্ড-মীরসরাই পাহাড়ীয়া এলাকা ঘুরে দেখলে বুঝা যাবে কী সর্বনাশ গত কয়েক বছরে করা হয়েছে।

সবচাইতে অবাক-বিস্ময়ের কথা চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার অনুমতি দিচ্ছে খোদ চসিক (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন), সিডিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তর স্বয়ং। অর্থাত্ কি-না রক্ষকই ভক্ষক? এই দায়িত্বহীনতার শেষ কোথায়?

পাদটীকা: প্রকৃতির রুদ্ররূপ আর তার প্রতিশোধ স্পৃহার দৃষ্টান্ত আমরা অহরহ টের পাচ্ছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দুর্বিপাকে মানুষের জীবন, সম্পদ আর জনপদকে প্রতিনিয়তই তছনছ করে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সচেতনতা কই? আমরা কি তবে সর্বনাশের চূড়ান্ত সীমানায় না পৌঁছানো পর্যন্ত থামছি না?

লেখকঃ গবেষক,প্রাবন্ধিক

লেখাটি ১৮/১২/২০১৩ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক’এর উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics