জলবায়ু পরিবর্তনে স্থানচ্যুত মানুষের পুনর্বাসনে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন : ইপসার সভায় বক্তাদের অভিমত

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানচ্যুতির ঘটনা বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং স্থানচ্যুত মানুষের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রামের পাহাড়ের পাদদেশ, বেড়িবাঁধ এবং বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্থানচ্যুত মানুষেরা। কিন্তু এসব স্থানচ্যুত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সরকারী বা বেসরকারী পর্যায়ে কোন পরিসংখ্যান নেই। এসব অসহায় মানুষের কার্যকর পুনর্বাসন এবং মনিটরিং এর জন্য পরিপূর্ণ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা এখন খুবই প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে গত ২০ মার্চ সমাজ উন্নয়ন সংস্থা ইপসার উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার বিষয়ক মতবিনিময় সভায় বক্তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্থানচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ এবং তাদের আবাসন, ভূমি এবং সম্পত্তির অধিকাকারের প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের পরিচালক মো. জাফর আলমের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. হাছান মাহমুদ, মাননীয় সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। Chief Guest Dr. Hasan Mahmud at Round Table Discussion Meeting Today
ইপসার প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া মতবিনিমিয় সভায় ডিসপ্লেসমেন্ট সলুশ্যানের সহায়তায় চলমান বাংলাদেশ হাউজিং, ল্যান্ড এন্ড প্রোপার্টি রাইটস শিরোনামে স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের অগ্রগতি ও অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন ইপসার এইচএলপি প্রকল্পের টিম লিডার মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু বিপদাপন্ন দেশ হিসাবে স্বীকৃত। গড়ে প্রতি বছর দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং প্রতি চার থেকে পাঁচ বছরে একবার মারাত্বক বন্যায় দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশে এই পর্যন্ত ৬০ লক্ষ লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানচ্যুত হয়েছে । শুধুমাত্র সমুদ্র স্ফীতির ফলে আগামী ৪০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ ভিটে হারা/ স্থানচ্যুত হবে। বাংলাদেশের জলবায়ু স্থানচ্যুতির অন্যতম কারণ হচ্ছে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মুল ভূখন্ডে নদী ভাঙ্গন। এছাড়া ঝড়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং মূল ভূখন্ডে নদীতে বন্যার হার বৃদ্ধি। সাধারণত বাংলাদেশের প্রাথমিক ভাবে উপকূলীয় ও নদী বিধৌত অঞ্চলগুলোতে ভিটে হারার মাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়। ইপসার সাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষনা প্রতিবেদন “বাংলাদেশের জলবায়ু স্থানচ্যুতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ” এ বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৬টি জেলায় নদী ভাঙ্গন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ইপসা বিভিন্ন গবেষণা ও কর্মশালার সুপারিশের উপর ভিত্তি করে জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধান পাঁচটি করণীয় নির্ধারণ করেছে যা বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করার মাধ্যমে জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষদের সমস্যার টেকসই ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে পারে। আশা করা যায়, প্রস্তাবিত সকল করণীয় বিষয়গুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এবং বাংলাদেশে কর্মরত সকল সুশীল সমাজের সংগঠনসমূহের অকুন্ঠ সমর্থন লাভ করবে।
মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধের উপর আলোচনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শায়রুল মাশরেখ, ড. মনজুরুল কিবরিয়া, ড. শাহাদাৎ হোসেন, ড. আমীর মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু আহমেদ আব্দুল্লাহ, সচেতন নাগরিক কমিটির প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, সাংবাদিক ওমর কায়সার, সংশপ্তকের প্রধান নির্বাহী সৌরভ বড়–য়া, বাংলাদশে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক মো: তায়েফুর করিম, সপ্নীল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মো. আলী সিকদার, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার এডভোকেট রেহেনা কবির রানু ও মনোয়ারা বেগম প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অথচ এর জন্য উন্নত বিশ্বের ভূমিকাই বেশী। বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু স্থানচ্যুতির প্রভাবকে বিশ্বব্যাপী আলোচিত করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জোড়ালো ভাবে দাবী উপস্থাপন করছে। এই ইস্যুতে আমাদের রাজনীতিকরণের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচি, জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র ও কর্ম পরিকল্পনা, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড এবং তহবিল গঠন করেছে যা বিশ্¦ব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৫১ সালে প্রণীত রিফিউজিস কনভেশনের ধারা হালনাগাদ করে স্থানচ্যুতির প্রসঙ্গটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রতি দাবী উপস্থাপন করেছে।
ড. হাছান মাহমুদ ইপসা কর্তৃক প্রস্তাবিত স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাঁচটি প্রধান করণীয়- চলমান জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আইন ও নীতিমালায় জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের অধিকারকে অন্তর্ভূক্ত করা ; সারা দেশে জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষদের মনিটরিং প্রক্রিয়ার আওতায় আনা ; জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারী খাস জমি বন্দোবস্তি স্বচ্ছ, কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত করা ; অকৃষি খাস জমি জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের জন্য বরাদ্দ দেওয়া এবং জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের জন্য কার্যকর প্রত্যাবর্তন, স্থানান্তর ও পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহন ও বাস্তবায়ন করার সুপারিশ যুগোপযুগী এবং তিনি একমত বলে মন্তব্য করেন।

উল্লেখ্য, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ডিসপ্লেসমেন্ট সল্যুয়েশন-এর সহযোগিতায় ইপসা ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ হাউজিং, ল্যান্ড এন্ড প্রোপার্টি রাইটস ইনিটিয়েটিভ শিরোনামে জলবায়ূ স্থানচ্যুত মানুষের সমস্যা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন সম্পর্কিথ বেশ কিছু নীতিমালা বাংলাদেশ সরকারের থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনে স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন নীতিমালা গ্রহণ করেনি। এই নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে ইপসা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মতবিনিময় করে যাচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics