জলবায়ু পরিবর্তনে ঢাকার পরিবেশগত সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে

বাংলাদেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকা মহানগরী পৃথিবীর দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলোর অন্যতম। নানা সংকটে এ মহানগর বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বাসস্থান, যাতায়াত, বিনোদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ মৌলিক ও প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে নগরবাসীকে প্রতিনিয়তঃ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । উন্নত বিশ্বের ভোগবিলাসী জীবনযাত্রার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন, বিশ্বময় উষ্ণতা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ঢাকা মহানগরীর পরিবেশগত সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), আইইডি ও জনউদ্যোগের যৌথ আয়োজনে ০৩ জুন ২০১৪, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে “জলবায়ু পরিবর্তন ঃ ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

সাম্প্রতিক কালে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের বর্ধিত আনাগোনা ও প্রচন্ডতায় বাংলাদেশের জনজীবন, কৃষি, ভৌত অবকাঠামো অহরহই বিপর্যস্ত হচ্ছে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে আমরাই হবো অন্যতম বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ দেশ। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমুল পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের স্বাস্থ্য সঙ্কট বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়েছে যে কোন মৌসুমের ক্ষেত্রে, বৃষ্টিপাত আগের মতো হচ্ছে না, ধরন ও সময় বদলে গেছে। ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের আঠারো শতাংশের বেশী ভূমি পানির নীচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। এছাড়াও উজানের পানি প্রবাহে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়বে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠি উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী এলাকার ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ¦াস্তু হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষকে ঢাকার বস্তিতে বসবাস করতে বাধ্য করছে। জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী-খাল, জলাভ’মি ও নি¤œাঞ্চল দখল ও ভরাট, ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণ, ভ’গর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন, বায়ু দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ঢাকা মহানগরী পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।P1000264

ঢাকায় জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল-এর পরিমান ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল যথাক্রমে ৩২.৫০% ও ৫২.৫০% হ্রাস পেয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন হাউজিং কোম্পানীগুলো নি¤œাঞ্চল ভরাট করছে। একই ভাবে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও নি¤œাঞ্চল ভরাট করছে। জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল ভরাট ও দখলের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে এবং নগরবাসী প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধার শিকার হচ্ছে।

অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলন করে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এ কারণেও ঢাকা শহর ক্রমশ ডেবে যাচ্ছে। অধিক হাওে ভ’গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই ভ’গর্ভে পানির শূন্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহানগরীতে যেখানে ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলক’প ছিল, বর্তমানে তা ৬৬০টি। মাত্রাতিরিক্ত হারে ভ’গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় ঢাকার ভ’গর্ভস্থ পানি সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১৫০ থেকে ১৭০ ফুট নিচে অবস্থান করছে। ৭০’র দশকের প্রথম দিকে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মধ্যে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে পানি উত্তোলনের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হতো তা বর্ষা মৌসুমে ভরে যেতো। বর্তমানে এ স্তর রয়েছে ২০০ থেকে ২২০ ফুট নিচে। প্রতি বছর গড়ে ৪ ফুট হারে পানির স্তর নিচে নামছে। তবে গত কয়েক বছর ধওে প্রতি বছর পানির স্তর ১০ ফুট কওে নিচে নামছে। ভ’গর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে ২০ থেকে ৩০ বছর পর মিঠা পানির অভাবে ঢাকায় জনশূন্যের পাশপাশি ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, আইইডির প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর জ্যোতি প্রকাশ চট্রোপাধ্যায়, সহকারী সমন্বয়কারী তারিক হোসেন মিঠুল, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহানের প্রবন্ধটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন। Presentation for 03 june 2014

আলোচনা সভা থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশ জানানো হয়:
নদী নিয়মিত খনন করা, অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ করা, আঞ্চলিক নদীগুলোর পানি প্রাপ্তির লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা, পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন; গৃহস্থালী বর্জ্য পানি প্রবাহে ফেলা থেকে বিরত থাকা; ট্যানারীগুলো জরুরীভিত্তিতে স্থানান্তর এবং বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন ও বর্জ্য পরিশোধন করা; শিল্পকারখানায় বর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন এবং নিয়মিত তা পরিচালনা করা; নৌযানের ডিজাইনে বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা; বিআইডব্লিউ কর্তৃক নৌযানের বর্জ্য সংগ্রহকরণ ও তা পরিশোনপূর্বক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ; নৌযানের বর্জ্য ও তেল নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকা।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাচ্ছে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় দেশে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়াও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সমস্যাদি যথাযথভাবে তুলে ধরে সহযোগিতা চাইতে হবে। গ্রীণহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কার্যকর ভ’মিকা পালন করার পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের ২ কোটি জলবায়ু উদ¦াস্তুকে দায়ী দেশগুলোতে বসতি স্থাপনের সুযোগ প্রদানের এবং দায়ী দেশগুলোকে জলবায়ু উদ¦াস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবী জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics