চিকিৎসা কেন্দ্রিকতা নয় স্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে: পবা

পানি-বায়ু-শব্দ দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সুযোগের অভাব, ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন, ওষুধের মান ও দাম-এর নিয়ন্ত্রণে ঔষধ প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা, এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা বিক্রয় ও ব্যবহার তথা সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এক চরম হুমকির মুখে পড়েছে। আর প্রতিকার হিসেবে নতুন নতুন হাসপাতাল নির্মাণসহ কেবল চিকিৎসা ব্যবস্থায় জোর দেয়া হচ্ছে ফলে একদিকে রোগীর সংখ্যা যেমন আশংকাজনক হারে বাড়ছে। অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি বিশাল বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসা নেবার ক্ষমতা সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রধান প্রধান রাজনীতিক দলগুলোও প্রতিরোধ ব্যবস্থায় নজর দিচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে চিকিৎসা কেন্দ্রিকতা নয় রোধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। আজ ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, সকাল ১০:৩০মিনিটে জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ হেলথ এসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

 বক্তারা বলেন, জনগনকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দিয়ে রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো শিখিয়ে দিলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতাল নির্মাণ বা ঔষুধ ক্রয়ের প্রয়োজন কমে আসবে। খাদ্যকে বিষাক্ত ক্যামিকেল ও ভেজালমুক্ত করলে এবং পরিবেশকে স্বাস্থ্যসম্মত করলে মানুষের রোগ-ব্যাধি অনেকাংশে কমে আসবে। রোগ না হলে তো আর হাজার কোটি টাকার ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়, শত শত হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক ল্যাব নির্মান এবং জনে জনে রোগ সারানোর বিরাট খরচের বোঝা দেশ-সমাজ-পরিবার থেকে দুর হবে। সঠিক রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই পারে একটি দেশের মানুষের চিকিৎসার আমুল পরিবর্তন সাধন করতে।Health_POBA

বিএমএ এর সাবেক সভাপতি ডাঃ রশিদ ই মাহবুব এর সভাপতিত্বে ও পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন- বারডেমের ল্যাবরেটরি সার্ভিসের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম. মুজাহেরুল হক, বাংলাদেশ হেলথ এসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন এ কে এম মাকসুদ, পবা সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম, টিইউসির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ ওয়াজেদুল হক খান, ড. সমীর কুমার সাহা, ডা. এ.কে.এম মোস্তফা হোসেন, হেলথ এন্ড হোপের পরিচালক ডা. লেনিন চৌধুরী, ড. মাহফুজুল হক, ডা: আবদুর রহমান, উবিনীগের নির্বাহী প্রধান ফরিদা আখতার প্রমুখ।

 বিএমএ এর সাবেক সভাপতি ডাঃ রশিদ ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম শুধু চিকিৎসা সংক্রান্ত কার্যক্রমের সীমাবদ্ধ। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথমে শিক্ষা কারিকুলামে স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি স্কুলকে ছাত্রদের মেডিক্যাল রেকর্ড রাখতে বাধ্য করা। কোন হাসপাতালে প্রাইমারী সেকেন্ডারী এবং টারসারী চিকিৎসা প্রদান করা হয় তা সুস্পষ্টভাবে প্রর্দশন করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ্যাম্বুলেন্সের অনুমোদনের পূর্বে দেখা ড্রাইভার আর সহযোগীদের ফার্ষ্ট এইড জ্ঞান রয়েছে তা নিশ্চিত করা।

 ডা: লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যকে পণ্য নয়, মানবাধিকার হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি হবে এ বিষয়ে আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বাইরের কোন গোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।

 এম মুজাহেরুল হক বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে সকল মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ লোকের স্বাস্থ্যসেবা কেনার সামর্থ্য নেই। ৫ লক্ষ ৪০ হাজার লোক দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের লোককে যদি রোগ হতে রক্ষা করতে পারি তবে স্বাস্থ্য ব্যয় সমস্যা হবে না। আমাদের পাবলিক হেলথ পলিসি প্রণয়ন করতে হবে, শুধু স্বাস্থ্য পলিসি নয়।

 ফরিদা আখতার বলেন, সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নয়ন করতে হবে এবং রাষ্ট্রায়ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। সরকার পরিচালিত চিকিৎসা ব্যবস্থার শুধু সমালোচনা বেসরকারী চিকিৎসাকে প্রসার করে। সরকারী চিকিৎসায় রেফারেলকে উন্নত করতে হবে। গার্মেন্স কারখানার বা শ্রমিকের স্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে আসা প্রয়োজন বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়কে দেখতে হবে। জেনিটিক্যাল মোডিফাইট খাদ্য চাষের উৎপাদন ও স্বাস্থ্যেও উপর প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্বে সাথে ভাবতে হবে।

 ডাঃ শুভাগত চৌধূরী বলেন- রোগ প্রতিরোধে আমি এখন হাটা ও তাজা শাক সবজি খাবার পরামর্শ দিতে ব্রিবত বোধ করি। কারণ হাটার জন্য ফুটপাত নেই এবং খাবারে ভেজাল। চিকিৎসা বলতে বোঝায় হাসপাতাল, ঔষধ, বড় বড় হাসপাতাল। তাই চিকিৎসার মাঝে ব্যানিজ্য আসছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রতিরোধের বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের জনস্বাস্থ্য বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।

 ডাঃ ওয়াজেদুল হক খান বলেন- গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাই। কিন্তু আমাদের চিকিৎসা গণমুখী নয়। আমাদের চিকিৎসাকে ব্যবস্থাকে জনগনের দোরঘোরায় নিয়ে যেতে হেবে। শুধু অবকাঠামো করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নত করতে পারবে না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে।

 এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতিতে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এ ধরনের কার্যক্রমগুলো বন্ধে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সচিব, ঔষধের দাম ও মান একটি বড় সমস্যা। ঔষদের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পবা’র প্রস্তাবনাসমূহ-

চিকিৎসা কেন্দ্রিকতা নয় স্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জোর দেয়া সেই আলোকে “স্বাস্থ্য নীতিকে” “জনস্বাস্থ্য নীতি”-তে পরিণত করা
পরিবর্তিত “জনস্বাস্থ্য নীতি”র আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে শুধু চিকিৎসা কেন্দ্রিকাতা থেকে বের হয়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে তার কার্য পরিধি বিস্তৃত করে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় সাধন করা। সেই আলোকে “রূলস অব বিজনেস” ও “এলোকেশণ অব বিজনেস” এর পরিবর্তন করে সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ঢ়েলে সাজানো।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নীতিমালা ও কর্মসূচী জনসমক্ষে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা।
ঔষধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যে সরকারি আদেশের মাধ্যমে ঔষধের দাম নিয়ন্ত্রণহীণ হয়েছে সেই সরকারি আদেশ প্রত্যাহার করে সরকারিভাবে দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা পুণ:বহাল করা।
স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার পরিধি বিস্তৃতি করা এবং গুণগত মান উন্নয়ন করা।
গুণগত চিকিৎসা সেবা প্রত্যন্ত এলাকায় পৌছে দেয়ার জন্য সরকার গৃহীত ডিজিটাল পদ্ধতি আরও দ্রুত প্রসারিত করা।
প্রাইভেট ক্লিনিক/হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শ্রেণীবিন্যাস করে চিকিৎসা সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ ও দাম সর্বনিন্ম পর্যায়ে রাখতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
নিয়ন্ত্রণহীন এ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা বন্ধ করে এ্যাম্বুলেন্সের গুণগত মান নিশ্চিত ও সেবা খরচ নিয়ন্ত্রণ করা। সেই লক্ষে এ্যাম্বুলেন্সের পৃথক রেজিস্ট্রেশন প্রথা এবং চালকের প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্বলিত পৃথক ড্রাইভিং লাইস্ন্সে প্রথা চালু করতে হবে।
সরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমন্বয়হীনতা দূর করে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাক্তার, নার্স, পরীক্ষা সুবিধা বৃদ্ধি করে চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়ন করা। এক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পাঠ্যসূচীতে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্বসহকারে অর্ন্তভ’ক্ত করা। “চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায়” জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলিকে অধিকতর গুরুত্ব সহকারে পাঠ্যসূচীতে অন্তুর্ভূক্ত করতে হবে।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics