ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসরণ: জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কে?

সাইফুর রহমান সুমন

কার্বন ডাই অক্সাইড বিগত কয়েক দশক ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে। হিসাব কষাও ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে যে ঠিক কি পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে। জলবায়ুর বিশ্ব সম্মেলন-২০০৯ ব্যার্থ হওয়ার পিছনে এটিকে অন্যতম কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়। উন্নত বিশ্বকে একটি নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছিল,  কিভাবে তাঁরা তাদের কার্বন নিঃসরণের হার কমিয়ে আনবে, ঘুচাবে কার্বন ঋণের দায়বদ্ধতা। কিন্তু সাম্প্রতিক হিসাব বলছে সম্মেলনের মাইল ফলক অর্জন সম্পূর্ণরূপে ব্যার্থ হয়েছে। সে সাথে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে আসলে দায়ী কারা!glo

সাম্প্রতিক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান হিস্ট্রি রিভিউ থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধে প্রকৃত দায়ী কারা তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ফসিল ফুয়েল তথা জীবাশ্ম জালানির দ্বারা পরিবেশে এর প্রভাব নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা জীবাশ্ম জালানির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে পরিবেশ কতটা টেকসই হতে পারে তার মানও নির্ধারণ করেছেন। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের ফলে উন্নত বিশ্বের জন্য প্রতি একক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষকরা এই মূল্য ব্যাবহার করে পরিবেশের উপর এর প্রভাব আলোচনা করেছেন। যেহেতু একটি দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বে বিরাজ করে আসছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, কোন দেশই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারবে না। প্রত্যেকটি মহাদেশের ছোট বড় সব দেশকেই এর জন্য মূল্য দিতে হতে পারে। বিশেষত সমুদ্রতীরবর্তী দেশ সমূহ ক্ষতির দিক দিয়ে অগ্রগণ্য। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন খাদ্য উৎপাদন ও ক্রয় মূল্য বেঁড়ে চলেছে। এর ফলস্রুতিতে নিম্ন আয়ের দেশ সমূহ দারুণভাবে খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে আসছে বিগত কয়েক দশক ধরে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং এর ফলশ্রুতিতে সংঘটিত জলবায়ুর  বিরূপ পরিবর্তন যেসব দেশসমূহের ক্ষতি সাধিত হয়ে আসছে তাকে ‘গ্লোবাল ড্যামেজ কস্ট’ (জিডিপি) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর আওয়তায় আলোচনা করা হয় কতটুকু ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং সেসব দেশ উন্নত দেশ দ্বারা কি পরিমাণ অর্থ মূল্যদান হিসেবে পাবে। নীতিগতভাবে ‘গ্লোবাল ড্যামেজ কস্ট’ বলে যে, আমরা সবাই একই লাইফবোটে অবস্থান করছি এবং সবাই এর ক্ষতির জন্য দায়ী বা কারো দরুন অন্যের ক্ষতি হলে তাকে এর ব্যয়ভার নিতে হবে। সময়ের সাথে সাথে এই মূল্য বেড়ে চলেছে। কয়েক দশক আগেও এর মূল্য বর্তমান আকাশ চুম্বী মূল্যের চেয়ে বেশ কম ছিল এবং তা ছিল একটি নির্ধারিত মাত্রায়। কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে মজুতকৃত দূষক হিসেবে বিরাজমান। পূর্বে প্রতি একক মাত্রা পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যোগ হলে যে পরিমাণ ক্ষতি করত, বর্তমানে তার মাত্রা কয়েক গুন বেশী।New-IPCC-report-disproves-its-own-predictions-on-global-warming

‘গ্লোবাল ড্যামেজ কস্ট’ তথা কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিব্যয় মাত্রা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা যাক। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ মূল্য কত হবে তা নির্ভর করে ভবিষ্যতে এর প্রশমন কিরকম হবে, তার উপর। কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমাণ প্রশমন করতে অনুন্নত দেশগুলোর কি পরিমাণ খরচ হবে তা ‘গ্লোবাল ড্যামেজ কস্ট’ নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। নিম্ন, মধ্যম ও উচ্চমাত্রা এই তিন শ্রেণী বিভাগায়নের দ্বারা বার্ষিক ‘গ্লোবাল ড্যামেজ কস্ট’ নির্ধারণ করা হয়। যুক্তরাজ্যে এই জিডিপি’র মাত্রা তেল সংকট এর প্রাক্বালে ১৯৭১ সালে দাঁড়িয়েছিল ০.৩% থেকে ৪.৩% এবং যুক্তরাষ্ট্রে তা হয়েছিল ০.৪% থেকে ৫.৪%। কার্বন ডাই অক্সাইড এর বার্ষিক প্রভাব হয়ত কম মনে হতে পারে, কিন্তু এর ক্রমবর্ধিষ্ণু মান অনেক বেশী প্রভাব বিস্তার করে। মাত্রা যতই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে, বাড়বে অর্থের পরিমাণ। যুক্তরাজ্যের জন্য এর সীমা নির্ধারিত ১০০ থেকে ১৪০০ বিলিয়ন ইউরো এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা ৯৬০ থকে ১৩,৬০০ বিলিয়ন ডলার। ক্রমবর্ধমান কার্বন ঋণের মাত্রা ২০০০ সালে যুক্তরাজ্যের জন্য ছিল ৯১৬ বিলিয়ন ইউরো এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল ৯৯৫১ বিলিয়ন ডলার যা ছিল সর্বাধিক মাত্রার। এই কার্বন প্রশমনের খরচ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি কতটা বিপদজনক আকার ধারন করছে জলবায়ু পরিবর্তন। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক ছিল ১৯০২-২০০৯ সালের মধ্যে, যা জিডিপি’তে ২৪-২৭% অবদান রেখে চলেছে। অন্যদিকে এই কার্বন হিসাব ব্যাবস্থায় যুক্তরাজ্যের অবদান ছিল ১৭-১৯%। উপরোক্ত হিসাব বলে দিচ্ছে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র, শুধুমাত্র এই দুই বৃহৎ শিল্পোন্নত দেশ সমগ্র বিশ্বকে কিভাবে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

তবে বর্তমানে এদের জিডিপি’তে অবদানের মাত্রা কিয়দংশ কমলেও, অপর মহাশক্তিধর রাষ্ট্র চায়না তাদের জিডিপি’র মাত্রা দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমানে চায়নার কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সর্বাধিক এবং জিডিপি’তে তাদের অবদান ১০-১২%। এই সব পরিবেশ সংক্রান্ত হিসাব নিকাশ অনায়েশে বলে দিচ্ছে শিল্প ও নগর প্রধান রাষ্ট্রগুলো বিগত কয়েক দশকেরও বেশী সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তনে নিষ্ঠুর ভুমিকা রেখে চলেছে। গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা এদের দ্বারাই বেশী তৈরী হয়েছে, যা পরবর্তীতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অগ্রগণ্য ভুমিকা রেখে চলেছে। উন্নত বিশ্ব কর্তৃক কার্বন ঋণের দায়ভার না ঘোচালে একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা প্রশমিত হতে হতে ক্ষতির মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে  পৌঁছাবে, তেমনি ঐতিহাসিক জলবায়ু পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা মাথায় নিয়ে অনুন্নত দেশের কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics