সিল্ক পাতায় অক্সিজেন! পৃথিবী নাকি ভীনগ্রহে নির্বাসন???

সিফাত তাহজিবা

ক্রুন খুব আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো। কেমন গুমোট একটা পরিবেশ !! কিন্তু জায়গাটা চিনতে পারছেনা! খালি একটা রুম, একটা লম্বা টেবিলের মত জিনিসটায় কয়েকটা কম্পিউটারের স্ক্রীন দেখতে পেল,তাতে কি সব নাম্বার উঠে আছে! রুমটার মাঝে লাল,নীল,বেগুনী রংয়ের মৃদু আলো ভেসে আছে। কোথায় যেন এমন একটা রুম দেখেছিল,সায়েন্স ফিকশন মুভিতে হয়ত; ভাবল ক্রূন। তক্ষুনি, কে যেন পাশে এসে দাঁড়ালো আর একটি ধাতব রংয়ের নভোচারীদের মতন একটি স্যুট এগিয়ে দিল। হ্যা,আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে চেহারা। প্রথম দেখায় যে কেউ প্রেমে পরে যেতে পারে! যেমনটা হয়েছে ক্রুনের ক্ষেত্রে। সংবিৎ ফিরে পেতেই এক নিশ্বাসে জিজ্ঞেস করল মেয়েটিকে, ‘আমি কোথায়? আপনি কে? আমি এখানে কেন? আমিতো ক্লাস শেষে হলে এসে ঘুমুচ্ছিলাম! আমাকে কি কিডন্যাপ করা হয়েছে?’ নাহ, মেয়েটি কোন উত্তরই দিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ক্রুন ! কেমন যেনো একটা অন্ধকার রুমে সে বসে আছে! কোন দরজাও দেখতে পাচ্ছে না যে এক ছুটে পালাবে!! এইতো, বাইরে জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আকাশটা এমন লাগছে কেন? হালকা সবুজাভ লাগছে কেন!!

মেয়েটি এতক্ষন ধরে ক্রুনের দিকেই তাকিয়ে ছিল, কিছুটা বিষন্ন মুখে ক্রুনের হাতে গোলাপী রংয়ের একটা খাম ধরিয়ে দিল!! ক্রুন অবাক হলেও খুব খুশি হয়ে খামটি খুলতে লাগল এই আশায়,এই অপরুপ মেয়েটিই কিছু লিখলো নাকি ভিতরে! কিন্তু, একি? ভিতরে চিঠিটি কোন ভাষায় লেখা? এর একটা বর্ণও যে বোধগম্য হচ্ছেনা ক্রুনের!!

ক্রুনের অসহায় অবস্থা দেখে মৃদু হাসল মেয়েটা। কি নিখুত হাসি! তাকিয়ে থাকল ক্রুন! চিঠিটা হাতে নিয়ে মেয়েটি পড়তে শুরু করল, ‘ক্রুন, তোমাকে ফিওপ গ্রহে পাঠানো হল, এই গ্রহে কোন অক্সিজেন নেই, তোমাকে মেপে মেপে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, এই নিয়েই তোমায় এখানে ১ মাস থাকতে হবে। কষ্ট হবে,কিন্তু বুদ্ধি খাটালে তুমি বেঁচে যেতে পার, নতুবা এখানেই তোমার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। তোমার অপরাধ পরিবেশ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হয়েও মানুষকে বৃক্ষ নিধন থেকে থামানোর কোনরূপ চেষ্টা করো নি। তোমার সার্বক্ষনিক দেখাশুনার জন্য লী আর ক্যাপ্টেন কিলিক্সকে সাথে দেওয়া হল।দু’জনই সাইবর্গ!যাদের কথা মানতে তুমি বাধ্য!’ চিঠিটির সমাপ্তি এখানেই।Silk-Leaf-by-Julian-Melchiorri_dezeen_02_644

ক্রুনের ইচ্ছা হলো সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে,কিন্তু তাও সে পারছে না কারণ এখানে যে অক্সিজেনই নেই।কি করে আগুন জালাবে? মেয়েটির নাম তাহলে লী, ওর মত সাইবর্গ হতে পারলে ভালই হত! মহাশুন্যে শুধুমাত্র এই অক্সিজেনের জন্যই তাকে এই শাস্তি দেওয়া হল!? ধাতব স্যুটটি পড়তে সাহায্য করল লী। অনেক ভারী আবার কিছুক্ষণ পরপর খেয়াল রাখতে হচ্ছে, কতটুকু অক্সিজেন আছে আর কতটুকুই বা সে নিল। দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন মেপে দেওয়া হয়েছে, বেশি লাগলে যেতে হবে কিলিক্সের কাছে,ফিওপ গ্রহের নেতা সে! মাত্র ২জন সাইবর্গের সাথে এই অক্সিজেন বিহীন গ্রহে ১ মাস থাকতে হবে! জরিমানা হলো,খাটাখাটনি করে আদায় করতে হবে অতিরিক্ত অক্সিজেনটুকু!!দুনিয়াতে মানুষগুলো নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলছে। তাদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই যে এই একটি জিনিসের উপর তারা নির্ভরশীল,এখান হেকেই পায় বেঁচে থাকার উপাদান অক্সিজেন। কি যে ভুল করছে তারা যদি একটিবারও বুঝত! ক্রুনও যে তাদের মতনই ছিল। কোন হিসাব মেলাতে পারছে না ক্রুন,ক্রোধে চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো তার।

“ক্রুন! এই ক্রুন! আর কত ঘুমাবি?।” কেমন যেন একটা ধাক্কা অনূভব করল ক্রুন। লী তাকে এভাবে ডাকছে কেন! ভাবতে ভাবতেই ঘুম জড়ানো চোখে তাকালো , আরে এইটাতো আহসান! দিব্যি চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে বাদাম খাচ্ছে, চোখে-মুখে রাজ্য জয়ের হাসি, ক্রুনের গভীর ঘুম ভাঙিয়ে অনেক মজ পেয়েছে সে। অন্য সময় হলে আহসানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত ক্রুন। কিন্তু এখন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। স্বপ্নই দেখছিল তাহলে!

যদিও মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল একটা চিন্তা, অক্সিজেনের জন্য এত কিছু!!!?? আসলেইতো পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার যোগানদাতা উদ্ভিদকুলকে দ্রুত নিধন করার ফলে গোটা পৃথিবীই ধীরে ধীরে ভিন্ন পরিবেশের স্বাদ পাচ্ছে।

কৃত্রিম জৈব পাতা
কৃত্রিম জৈব পাতা

পাঠক আপনিও একটু চিন্তা করে দেখুন তো, অদূর ভবিষ্যৎ এ কি আমাদেরও উপরের কল্পকাহিনীর ক্রুনের দেখা স্বপ্নে বিচরণ করতে হবে কিনা??? বিজ্ঞানের জন্মই বলা হয়ে থাকে প্রয়োজন থেকেই! আমাদের এই অতীব প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কি বৃক্ষের পাতার বদলে অন্যকিছু থেকে উদ্ভাবন সম্ভব কিনা, ভেবে দেখেছেন কি? গাছ যদি না থাকে আমাদের অক্সিজেন ফ্রীতে কে তৈরি করে দিবে?

ঠিক এই কাজটি করে দেখাল যুক্তরাজ্যের র্যেয়েল কলেজ অফ আর্ট থেকে ইনোভেশন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক পাশ করা ছাত্র জুলিয়ান(Julian Melchiorri)। তার উদ্ভাবন করা জিনিসটি হলো একটি ‘কৃত্রিম জৈব পাতা’! এই পাতা থেকেই পাওয়া যাবে অক্সিজেন, যা উদ্ভিদকূল শত সহস্র্র বছর ধরে আমাদের বায়ুমন্ডলে নির্গমন করে আসছিল। আর তা গ্রহণ করেই বেঁচে আছে এক একটি জীবের প্রাণ!

পাতাটি দেখতে খুব সাধারণ পাতার মতই মনে হবে, এটি তৈরি করা হয়েছে এক প্রকার সিল্কের সাহায্যে, যা আলো ও পানির সংস্পর্শে অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে; এমনটাই দাবী জুলিয়ানের। মানুষ আদিমযুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল! কৃত্রিম জৈব পাতাটি তৈরিতে যে ক্লোরোপ্লাস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি আবার উদ্ভিদ কোষ থেকে নিষ্কাষিত করা হয়েছে! এই ছোট ছোট সেলুলার পাতাকে আবার সিল্ক প্রোটিনে নিমজ্জিত করে রাখা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত! গাছ কখনোই শূন্য মাধ্যাকর্ষণে হ্য় না।

জুলিয়ানের মতে, নাসা এখনো মহাকাশে দীর্ঘ দূরত্বের স্থান যাতায়াতের জন্য অক্সিজেন উৎপাদন বিভিন্ন উপায় নিয়ে গবেষণা করে আসছে, এই সিল্ক লীফ বা কৃত্রিম জৈব পাতা মানুষকে মহাকাশে পূর্বের তুলনায় আরও অধিক সহজে আর দীর্ঘ সময় অন্বেষণে সহায়তা করবে।

জুলিয়ানের উদ্ভাবিত এই পাতাটি নিয়ে তার নিজ মুখেই শুনুন নীচের ভিডিওটিতে।

আবিষ্কারের নেশায় কিছু মানুষ মত্ত, আবার কিছু মানুষ আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর পরিবেশটাকে ধ্বংসের খেলায় মেতে আছে!
ক্রুনের মত যদি এদেরকেও নির্বাসনে পাঠানো যেত, মন্দ হত না!!!!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics