একদিন বাদুঁড়ের খোঁজে……

কাজী মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম

ঊষালগ্নে নিদ্রা দেবীর কোল থেকে যখন নামলাম, আবছা স্বপ্নের ঘোর তখনো কাটেনি। আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম অনেকগুলো বাদুঁড়ের মাঝখানে , একলা আমি খেলা দেখছি তাদের । হঠাৎ সেলফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দ জানান দিল বাইরে সবাই অপেক্ষা করছেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বর থেকে সিএনজি যোগে বহদ্দারহাটে পৌছালাম । বহদ্দারহাট থেকে বাস যোগে আড়াই ঘন্টার পথ পেরিয়ে চকরিয়া টার্মিনাল । সেখান থেকে মাহিন্দ্রা যোগে গ্রামের মেঠোপথ ধরে ধুলো ওড়া পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌছালাম আমাদের কাঙ্কিত রেজাউল করিমের বাগানে । বাগানটি চকরিয়ার ভেওলা মানিকচর ইউনিয়নের বানিয়ারচর গ্রামে প্রায় ১ একর জমির উপর বিস্তৃত । গ্রামের নাম বানিয়ারচর হলেও কোথাও আমরা নামের স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম না । বাগানের চারিপাশে কিছু শাক সবজির ক্ষেত আর বিস্তৃত ফসলি জমি । বাগানের ভিতরে নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কয়েকটা টংঘর । আমরা গিয়ে বসলাম একটিতে এবং আসার কারণ করিম ভাইকে বললাম । শুনে তিনি অপলক দৃষ্টিতে সবিস্ময়ে বলতে লাগলেন “ বাদুঁড় একটি নিলর্জ্জ প্রাণি, অন্ধ আবার নোংরাও বটে, ওরা আমাদের উপকারের চেয়ে বাগানের বড়ই , সুপারি , তাল ইত্যাদি খেয়ে অপরিমেয় ক্ষতি করে যাচ্ছে ”(এটা শুধু করিমের কথা নয় বাংলাদেশের সব কৃষকের কথা ) শুনে আমরা হাসলাম এবং ওনাকে বললাম –বাদুঁড় নোংরা নয় , ওরা নিজেদের পরিষ্কার রাখতে যথেষ্ট সময় ব্যয় করে । শুধু কি নিজে ? তারা উড়ন্ত অবস্থায় শিকার পর্যন্ত পরিষ্কার করে খায় । গ্রামের অনেকেরই ধারনা , বাদুঁড় যে পথ দিয়ে খায় সে পথেই মল ত্যাগ করে । আসল তথ্য হলো-তারা শুধু রসটা খায় (stored glycogen ) আর বাকি উচ্ছিস্থটা ফেলে দেয় । আর তাদের শোষণ ক্ষমতাও (Absorptive Power)অনেক বেশি । বাদুঁড়কে আমরা সারা রাত খেতে দেখেছি , সেই সন্ধাবেলায় নিড় থেকে বের হয় আর ভোরে ফিরে । আমরা কিছুক্ষণ বাগানে ঘুরে রওনা হলাম বেতুয়া বাজারের উদ্দেশ্যে । বাজারে গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে অনেক অজানা এবং অদ্ভুত তথ্য জানলাম । সেখানকার অনেকেই বাদুঁড়কে কুলক্ষণ হিসেবেও দেখে । সন্ধ্যায় বাগানে ফিরে সেই নির্ধারিত টং ঘরে বসে জিপিএস মেশিন , হাইগ্রোমিটার ইত্যাদি চালু করে নেট লাগিয়ে অপেক্ষায় রইলাম কাঙ্ক্ষিত মেহমানের ( বাদুঁড়) ।fakrul and nurul islam emvironmentmove

২.

মাগরিবের আযান দেওয়ার সাথে সাথেই তাদের আনাগোনা দেখা যায় । একটু অন্ধকার নামতেই বিশাল ডানা ঝাপড়ানি তাদের উপস্থিতি জানান দেয় । আমরা চুপ চাপ ডানা ঝাপড়ানির শব্দ এবং তাদের উড়াউড়ি পর্যবেক্ষণ করছিলাম । আস্তে আস্তে শীতও তার অবস্থান পাকাপোক্ত করতে শুরু করলো। আমরা যার যার মতো করে অবস্থান নিলাম । রাত আড়াইটায় হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি আমরা যারা টং ঘরের বাইরে বসেছিলাম তাদেরকে একটু আদর দিল । কিছুক্ষন বাদুড়ের নিস্তব্ধতা লক্ষ্য করি । ঘন্টা খানিক পর থেকেই আবার তাদের ডানা ঝাপড়ানোর শব্দ কানে আসে । আমরা প্রতিটি ঘন্টায় কয়টা বাদুড় উড়ছে, কয়টার শব্দ শুনেছি , তাপমাত্রা , আর্দ্রতা ইত্যাদি লিখে রাখছিলাম । ভোর বেলায় আমাদের দেওয়া নেটে একটা বাদুড় ধরা পড়ে । তার শারিরিক গঠন এবং মাইক্রোমেট্রিক মেরিষ্টিক দেখে নিশ্চিত হলাম এটি Microciropetra , এরা ফলভোগী ,তাদের শারীরিক গঠন অনেকটা পাখির মত মনে হলেও তারাই একমাত্র স্থন্যপায়ী যারা উড়তে পারে । তাদের স্টার্নামে একটা কিল (keel ) আছে যেখানে বড় উড়ন্ত মাসল লাগানো থাকে । তাদের উইংটা একটি হাতের এর হাড় এবং একটি আঙ্গুল দ্বারা গঠিত । তাদের তাঁদের পাখায় অবস্থিত মেমব্রেনটা হাতের এর হাড় এবং বাকি চারটা বিস্তৃত আঙ্গুল দ্বারা গঠিত যেটি লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত যা দ্বারা বাদুড় উড়তে পারে । সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো , তাদের কান অবিশ্বাস্য রকমের   স্পর্শকাতর । তারা অন্ধও নয় কিন্তু অন্যান্য স্তন্যপায়ীর মতো ইকোলোকেশন বা শব্দত্তোর (A Biological Sonar System )ব্যবহার করে চলাফেরা করে যার মাধ্যমে তারা সূক্ষ্ণ জিনিস এমনকি অন্ধকারে চুল পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারে । বাদুড়ের পরিমাপ নিয়ে আমরা তাদের আশ্রয়স্থল দেখতে গেলাম । চকরিয়ায় প্রধানত দুই ধরনের রোস্ট(বাদুঁড়ের আবাসস্থল কে রোস্ট বলে) পাওয়া যায় । একটি বড় বড় গাছে (Generally Megaciropetra ) আর একটি পুরাতন পরিত্যাক্ত দালানে (Microciropetra ) ।fakrul islam environmentmove

পৃথিবীতে পোলার অঞ্চল এবং ধূ-ধূ মরুভূমি ছাড়া পৃথিবীর সব জায়গাতে কম বেশি বাদুঁড় পাওয়া যায় । বাদুঁড় আবার প্রাচীন এবং দীর্ঘায়ু প্রাণীও বটে ( প্রায় ৩৯ বছর ) যদিও তাদের প্রজনন ক্ষমতা সেই তুলনায় অনেক কম । কথিত আছে , সেই ডায়নোসরের যুগ থেকেই বাদুঁড় বাস করে আসছে ।নিম্ন প্রজনন ক্ষমতা এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির কারণে বাদুঁড় আজ হুমকির মুখে । ফলে বাস্তুতন্ত্রে নেমে আসছে বিশাল পরিবর্তন । আমরা অনেকেই জানিনা বাদুড় পরাগায়নের মাধ্যমে অসংখ্য গাছ পালাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করছে । দূরবর্তী স্থানে বীজ বিস্তরনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনায়নে ভুমিকা রাখছে । আবার ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষক ও দেশকে বিশাল আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে । পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০ মিলিয়ন মেক্সিকান মুক্ত লেজি বাদুঁড় বাস করে সেন্ট্রাল টেক্সাসের ব্রাকেন গুহায় । তারা ২০০ টন পোকামাকড় খায় প্রতিটি গ্রীষ্মের রাতে যার ওজন ৬টি কংক্রিট ভর্তি ট্রাক অথবা ৫০ টি এশিয়ান হাতির সমান । আবার, প্রায় ৪৫০ টিরও বেশি কমার্শিয়াল প্রোড়াক্টস যার মধ্যে ফাইবার , ডাইস , ফুয়েল , টিম্বার ইত্যাদি আসে বাদুঁড় নির্ভর গাছ থেকে । বর্তমানে বাদুঁড়ের লালা থেকে মস্তিষ্কের রোগের প্রতিষেধকের সন্ধান মিলছে । বলা বাহুল্য,পৃ্থিবীতে মোট ১১১১ টি প্রজাতির সন্ধান মিলছে যার মধ্যে ৩২ প্রজাতি বাংলাদেশে সনাক্ত করা হয়েছে (সূত্রঃ ড.আলী রেজা খান)  তন্মধ্যে ৩টি ফলভোগী এবং বাকীগুলো পতঙ্গভোগী । আরও নতুন নতুন প্রজাতি সনাক্তকরণের সমূহ সম্ভাবনা বাংলাদেশে রয়েছে ।

লেখকঃ সদস্য,গ্রুপ ফর কনজার্ভেশন এন্ড রিসার্চ অফ ব্যাট (GCRB) এবং ১৫ তম ব্যাচ ছাত্র,চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় E-mail: fakhruldvm15@gmail.com

Group: https://www.facebook.com/gcrb.org.bd

ফোনঃ ০১৬৭৫৪৪০৫১৭ ১

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics