প্রাণীঅধিকার নিয়ে “টিম প্রাধিকার”
জায়গাটা ঠিক সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এমন নয়, আম্বরখানা মোড় থেকে একখানা রিকশা বা অটোতে চেপে পৌঁছে যেতে বড়জোর পঁচিশ কি ত্রিশ মিনিট সময় লাগে বালুচর, বালুচর বাজার থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে; ভরদুপুরে হালকা রোদের উত্তাপ গায়ে মেখে পৌঁছানো গেলো ডেইরী ফার্ম, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আর টিলাগড় ইকো-ফরেস্টের প্রতিবেশী হয়ে থাকা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ছোটোখাটো গোছানো ক্যাম্পাস, চারিপাশে টিলা আর সবুজের মাঝে একটুকরো পাঠশালা। এখনো উন্নয়ন আর ভাঙা গড়ার কাজ ছলছে। উঠছে ক্লাস বিল্ডিং, ল্যাব, গবেষণাগার আর ছাত্রাবাস। কিন্তু, যে কারণে প্রায় আলোচনার বাইরে থাকা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এখন শুধু সিলেট নয় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে শ্রদ্ধা আর বাহবা পাচ্ছে তা একেবারেই ভিন্ন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন কিছু কাজ করা হয়েছে যা বাংলাদেশের প্রাণী অধিকার, প্রাণী বৈচিত্র্য,মোটা দাগে, প্রাণীজগৎ রক্ষায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। চলুন জেনে নেয়া যাক; কি করছেন “প্রাধিকার” নামে সংঘঠনের সেই উদ্যমী তরুণ দল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ডেইরী ফার্মের টিলায় বসেছিলাম প্রাধিকারের বন্ধুদের নিয়ে,উপস্থিত প্রাধিকারের বর্তমান সভাপতি রাহুল দাশ তালুকদার অভি, সহ সভাপতি নাইমুল ইসলাম, সাধারন সম্পাদক জয় প্রকাশ রায়, সহ-সাধারন সম্পাদক মিথুন দাস, কোষাধ্যক্ষ আকাশ খাসনবিস, আইনবিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার হিমেল, জনসংযোগ বিষয়ক সম্পাদক শাহেদ আহমেদ তাপাদার, সদস্য তণ্বী, বিপাশা, মেমিতা, চামেলী সহ অন্যান্য সদস্যরা। বিকেল তখন ম্লান সূর্যের আভা ছড়াতে শুরু করেছে, সদাহাস্য রাহুল দাশের কাছে প্রশ্ন রাখি কেন এই প্রাধিকার??উত্তরটি বোধহয় রাহুল দাশের মগজে মননে একেবারে গাঁথাই ছিল,প্রস্তুত ছিলেন বোধহয় এই প্রশ্নের জন্যেই। স্মিত হেসে শুরু করলেন- মানবাধিকার যখন চরম বিপর্যস্ত হয়, তখন মানুষ ব্যতীত প্রানিকূলের অন্যান্য জীবের অধিকার নিয়ে খুব কম মানুষই ভাবে। কোন জীবের বেঁচে থাকার অধিকারগুলো যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন ঐ জীবের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। এই অবস্থায় প্রানী অধিকারগুলো সমুন্নত রেখে ভারসাম্যপূর্ন পরিবেশ বজায় রাখতে হলে মানুষকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে।এই লক্ষ্যেই, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে “প্রানী বাচুক পৃথিবী বাঁচুক” এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে গঠন করা হয় প্রাধিকার । আরও কিছুটা ব্যাখ্যা চাই, বলতেই নড়েচড়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত হলেন সাধারণ সম্পাদক জয় প্রকাশ রায়, শান্ত স্বভাবের জয় যেন কিছুটা চঞ্চল হলেন নিজেদের কাজের পরিধি বিস্তারিত বর্ণনা করতে, তাঁর কথা শুনতে শুনতে চোখ ঘুরিয়ে নেই উপস্থিত প্রতিটি সদস্যের দিকে, প্রত্যেকের মধ্যেই যেন কাজ করার ,ভালো কিছু করার অদম্য আর বাড়ন্ত স্পৃহা ফুটে উঠছে। তাঁরা জানিয়ে দিতে চান তারা কি করছেন, তারা চান এমন একটা ভালো কাজের সাথে আমাকেও যুক্ত করে নিতে। যাইহোক,প্রাধিকারের কর্মবিস্তৃতি সম্পর্কে বলছিলেন জয় প্রকাশ- প্রাণী অধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্গন ও অপরিকল্পিত শিল্পায়নের অজুহাতে প্রকৃতি জীবের জৈবিক ক্রিয়া চালিয়ে যাবার অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে সেই দিকে লক্ষ্য রেখে প্রাণী অধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন সচেতনামূলক সেমিনার আয়োজনসহ বিনামূল্যে ভ্যাকসিনেশন,বিশ্ব প্রাণী দিবস, বাঘ রক্ষা দিবস, ফ্রগ ডে পালন , জাতীয় পরিবেশ রক্ষা দিবস, বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন করেছে প্রাধিকার। টিপাইমূখে বাঁধ নির্মানের প্রতিবাদসহ রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদী সভা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করে। প্রাধিকারের লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট রাহুল দাশ তালুকদার অভি বলছিলেন , ইতোমধ্যে প্রাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন জনসচেনতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছি । আশাকরি সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে দেশীয় সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে পারবো “
সাধারন সম্পাদক জয় প্রকাশ রায় কিছুদিন আগে টিলাগড় ইকোপার্কে সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়ার কথা স্মৃতিচারন করে বলেন, “ঐ রাতে প্রাধিকারের প্রতিনিধিদল সেনাকর্মকর্তা ও বনবিভাগের উচ্চকর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলেও উনাদের অবহেলায় ফায়ারিংয়ের বিকট শব্দে ইকোপার্কের পশুপাখির অবস্থা খুব নাজুক অবস্থায় ছিল। তবে সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে প্রাধিকার নিয়ে অনেকদূর আগাবে বলে মনে করি।” সাথে প্রাধিকারের সাংগঠনিক সম্পাদক (বণ্যপ্রাণি বিষয়ক) নুপুর ধর উদ্বিগ্ন হয়ে যোগ করলেন ,” এদেশের অধিকাংশ মানুষ গৃহপালিত প্রাণী ও বন্যপ্রাণী র মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা। আর যে কারণে বন্যপ্রাণী হত্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে।তবে প্রাধিকারের জনসচেতনাতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষনে অন্যতম সহায়ক হবে।” আইনবিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার হিমেল প্রথমেই প্রচলিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষনমূলক আইনগুলোর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বনবিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তারা আইনসমূহ জেনে থাকলেও তা মেনে চলার ব্যাপারে কখনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না যা সত্যিই দূঃখজনক । তবে প্রাধিকারের পক্ষ থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষনবিষয়ক নীতিমালাসমূহ যথাযথভাবে পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে সার্বক্ষনিক জোর দেয়া হয় বলে জানালেন জনসংযোগ বিষয়ক সম্পাদক শাহেদ আহমেদ তাপাদার। সহ-সাধারন সম্পাদক মিথুন দাস বললেন “ প্রানিদের বেঁচে থাকার সুস্থ পরিবেশ তৈরী করতে প্রাধিকার বদ্ধপরিকর। আর এ লক্ষে প্রাধিকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। “প্রাণী অধিকার সংরক্ষণের ব্যপারে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রাধিকার সিকৃবিতে বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করেছে ।এছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থা পেটার সাথেও কাজ করছে প্রাধিকার ।” যোগ করে প্রাধিকারের সহ-সভাপতি নাঈমুল ইসলাম।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাই সভাপতি রাহুল দাশের কাছে, জানালেন, বিভিন্ন স্কুল কলেজে ছাত্রদের মাঝে সচেতনতা তৈরী করা, অবুঝ প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ বন্ধে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বর্তমান সংখ্যা নিয়ে একটি জরিপ চালানো, সিলেট অঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, আর প্রাণী অধিকার আদায়ে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে দেশের মানুষকে প্রাণী অধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ করা।
প্রাণিদেরও জীবন ও অনুভূতি আছে ।এরাও সামাজিক জীব ।তাই তাদেরকে অযথা কষ্ট দেওয়া কখনোই কাম্য নয় । এ দেশের মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা যতোদিন তৈরি না হবে ,ততদিন প্রাণী অধিকারও সংরক্ষিত হবে না । জনসাধারণের মধ্যে এই সচেতনতা ও অনুভূতি সঞ্চারনই এখন প্রাধিকারের প্রাথমিক লক্ষ্য । “এদেশ একদিন হবে প্রাণিদের অভয়ারণ্য”- এই স্বপ্নের রঙে বাস্তবতা রাঙানোর অভিপ্রায়ে প্রাণীপ্রেমী এক ঝাঁক প্রাধিকারকর্মী কাজ করে চলেছে নিরলস ! দারুণ চমৎকার একটা আড্ডার সময় কেমন করে ফুরিয়ে এলো তা বোঝা গেলো হালকা হালকা শীতের হাওয়া গায়ে লাগার পর। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে টিলায়। বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরেন প্রাণী আর প্রকৃতি রক্ষার তরুণ সেনানীরা। আমাদের সাথী হয় পাহাড় সমান আত্মবিশ্বাস আর প্রাণীর জন্য ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন প্রাধিকার বন্ধুদের কথামালা আর সাহসিকতা।