দুর্গম এক জলপ্রপাতে দুর্লভ এক পাখি

পাখিপ্রেমীদের জন্য শ্রীমঙ্গল একটি আদর্শ জায়গা। বিশেষ করে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে একবার কেউ গেলে তাকে ওখানের রূপ-রস-বর্ণবৈচিত্র্য চুম্বকের মতো বারবার আকর্ষণ করবে বলেই আমার ধারণা। প্রথমবার গিয়েই জায়গাটার প্রেমে পড়েছি, বিমুগ্ধচিত্তে এর অপরূপ শোভা উপভোগ করেছি আর এই মুগ্ধতার রেশ কখনো কমবে না বলেই আমার ধারণা। প্রথমবার গিয়েছিলাম ৩০শে নভেম্বর, ২০১২ NKC এর একটি ওয়াইল্ড ট্রিপে। তখন বেশ বড় একটি দলের অংশ ছিলাম। এরপর ফেব্রুয়ারিতে টানা তিন দিন বন্ধ পেয়ে বন্ধু শওকত সুমনের সাথে আবার ছুটলাম শ্রীমঙ্গলে। প্রথমদিনে লাউয়াছড়ায় ঘুরতে গিয়ে পরিচয় আরো দুই প্রকৃতিপ্রেমী ও অ্যাডভেঞ্চারার নওজেশ পাটোয়ারী এবং পারভেজ রবিনের সাথে। সেদিন ওনাদের সাথে নিয়েই ঘুরলাম লাউয়াছড়া উদ্যান আর বিকালে গেলাম বাইক্কা বিলে পাখি দেখতে। তবে আজ এ ব্যাপারে বিস্তারিত না বলে পরের দিনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েই কথা বলব। এ লেখার উদ্দেশ্যও সেটাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনভর ঘোরাঘুরি শেষে সেদিন সন্ধ্যায়ই প্ল্যান করলাম পরের দিন যাব হামহাম ঝর্ণা/জলপ্রপাত দেখতে। সাথে গাইড হিসেবে চারজনের আরেকটা দলকে পেয়ে গেলাম যাদের একজনের আগেই হামহাম যাবার অভিজ্ঞতা আছে। সেদিন রাতেই পরের দিনের সব প্ল্যান ফাইনাল করলাম।

নীল পানগির্দি Plumbeous Water Redstart (female) by Balaji Pg
নীল পানগির্দি Plumbeous Water Redstart (female) by Balaji Pg

পরদিন ভোরে শ্রীমঙ্গল থেকে আমরা চারজন প্রথমে সিএনজিতে করে ভানুগাছ বাজারে গেলাম। সেখান থেকে সিএনজি রিজার্ভ করলাম একেবারে কলাবনপাড়া আদিবাসী বস্তি পর্যন্ত। হামহাম জলপ্রপাত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহিন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। অপূর্ব এই জলপ্রপাতে যাবার চমৎকার সচিত্র সব বর্ণনা এখন গুগল সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। আমি তাই ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনায় নাই গেলাম। কলাবনপাড়া থেকে পায়ে হেঁটে শুরু হল আমাদের হামহাম যাত্রা। দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তায় অনেক চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে সে এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা। পথে বেশ কয়েকটা পুকুর পেরিয়ে যেতে হয়। যাত্রার শুরু থেকেই চোখ রাখছিলাম যে কী কী পাখি দেখা যায়। তবে একটু বেলা হয়ে যাওয়াতেই কিনা পাখিরা আমাকে বেশ নিরাশ করলো। যাবার সময় অবশ্য আমদের সবচেয়ে ছোট টিয়া লটকন (Vernal Hanging Parrot) এর দেখা পেয়ে গেলাম। এই বনে এরা বেশ ভালো সংখ্যায়ই আছে। প্রায় চার ঘণ্টার প্রাণান্ত পরিশ্রমের পর শরীরের সকল পানি নিঃশেষ করে অবশেষে পৌঁছে গেলাম পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই জলপ্রপাতের কাছে। দূর থেকেই পানি পড়ার আওয়াজ কানে আসছিল। কাছ থেকে মনোভিরাম সেই দৃশ্য দেখার পর শরীরের সকল ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেল। আর বরফশীতল পানিতে মুখ-হাত ধোয়ার পর সেই পানি পান করে শরীর-মন যেন জুড়িয়ে গেল। একটু গুছিয়ে নিয়েই জলপ্রপাতের কাছে ছুটলাম।

আর সেই সময়ই দৃষ্টি আকর্ষণ করল চঞ্চল এক পাখি। ঝর্ণার কাছেই যে ডুবো পাথরগুলো ছিল সেখানেই বসে ছিল পাখিটা। আর একটু পর পর চমৎকার দর্শনীয় ভঙ্গিতে বাতাসে উড়ে বেড়ানো পোকা ধরে আবার এসে বসছিল সেই পাথরগুলোর ওপরে। মাঝে মাঝে ঝর্ণার জলধারাকে অগ্রাহ্য করে সেখানেও কীভাবে যেন বসে পড়ছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আশেপাশে যে এত মানুষ পাখিটা সেটা একেবারেই পাত্তা দিচ্ছিল না। সে একমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছিল আর আমি প্রাণভরে তার কর্মকাণ্ড উপভোগ করছিলাম। ফিল্ড গাইড সাথেই ছিল বলে পাখিটির পরিচয়ও বের করে ফেললাম বেশ দ্রুতই। এটি ছিল একটি Plumbeous Water Redstart (Rhyacornis fuliginosa), বাংলা নাম নীল পানগির্দি। বাংলাদেশের একটি বিরল পরিযায়ী পাখি। আমার দেখা পাখিটি ছিল মেয়ে। পুরুষ ও মেয়ের গায়ের রঙে ভালোই বৈপরীত্য দেখা যায়। পুরুষ পাখিটির গায়ের রঙ ফিকে নীল-ধূসরাভ, লেজ পিঙ্গল বা লালচে-বাদামী। মেয়ে পাখির রঙ গাঢ় ধূসরাভ-বাদামী, ডানায় দুই সারি সাদা ফোঁটা। ঠোঁট ও পা কালচে বাদামী।

এরা দ্রুত প্রবহমান পাহাড়ি জলস্রোত বা নদীর আশেপাশে বাস করে। সাধারণত একা বা জোড়ায় দেখা যায়। উষা ও গোধূলিলগ্নে বেশি তৎপর থাকে। এরা মূলত পোকাখেকো, তবে বেরিজাতীয় ফলও খায়। এরা প্রজনন করে হিমালয়ে, এপ্রিল-জুলাই সময়কালে। পানির কাছাকাছি পাহাড়ের গর্তে, পাথরের ফাটলে বা গাছে মস, ঘাস, পাতা প্রভৃতি দিয়ে তৈরি কাপের মতো ছোট বাসা করে। মেয়ে পাখি ৩-৬টি ধূসর-সবুজ ডিম পাড়ে এবং একাই ডিমে তা দেয়। গৃহস্থালির বাকি সব কাজ পুরুষ-মেয়ে দুজন মিলেই করে।

চমৎকার এই পাখিটির আমাদের দেশে অবস্থানের পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তবে সিলেট বিভাগের জলপ্রপাতগুলোতে শীতকালে এরা নিয়মিতই আসে, তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাই এদের একটির দেখা পেয়ে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে করছি। তবে জলপ্রপাতগুলোতে ট্যুরিস্টদের মাত্রাতিরিক্ত ভিড় আর যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশ কলুষিত করাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে এসব সুন্দর পাখিরা ভবিষ্যতেও নিয়মিত আসবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই এই ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। এই চমৎকার বর্ণিল পাখিদের আবাসস্থল রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার এবং আমরা সবাই সেই দায়িত্ব পালনে সচেতন হবো সেই প্রত্যাশা রইল।

লেখকঃ

আলী রেজা হায়দার
পেশায় সহকারী কমিশনার (শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট), পাখিপ্রেমী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics