'কালাপানি' নিয়ে বহে বুড়িগঙ্গা

তৌফিক মারুফ

বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। কিন্তু সীমাহীন দূষণের কারণে বহু দিন ধরেই সেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। শত উদ্যোগেও শাপমুক্তি ঘটছে না বুড়িগঙ্গার। দিন দিন বাড়ছে দূষণের মাত্রা। বুড়িগঙ্গার দুই তীরের মানুষ জানিয়েছে, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বুড়িগঙ্গার পানির রং এখন সবচেয়ে কালো। এই ‘কালাপানি’র উৎকট গন্ধে নদীর পাড়ে দুই দণ্ড তেষ্টানোই দায়।image_1197_336515
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারদিকের নদী দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প, টাস্কফোর্সের সভা ও সিদ্ধান্ত, বেসরকারি পর্যায়ের নানা কর্মসূচি, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম_কোনো কিছুই কাজে আসছে না। বুড়িগঙ্গার মৃত্যুফাঁদ হিসেবে পরিচিত হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো এখন পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুসারে বুড়িগঙ্গার পানির ডিও লেভেল ১.০০ এমজি/১-এর চেয়েও কম। জীববৈচিত্র্যের নিরাপত্তার জন্য ন্যূনতম উপযুক্ত মাত্রা প্রয়োজন ৪.৫০ এমজি/১।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানি ও উৎকট গন্ধ থেকে আশপাশের এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি।
গত শনিবার রাজধানীর বসিলা সেতুর নিচ থেকে বুড়িঙ্গার তীর ধরে একে একে ঝাউচর, ঝাউলাহাটি, গুদারাঘাট, মাদবর বাজার ঘাট, নিজামবাগ, নূরবাগ, মুসলিমবাগ, সোয়ারিঘাট, কয়লাঘাট, ইসলামবাগ, লালবাগ ও বাদামতলী হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে চোখে পড়ে নদীতে নির্বিচারে বর্জ্য ফেলার চিত্র। পাকা সড়ক ঘেঁষে নদীর ভেতর পর্যন্ত একটু পর পর কয়েক মিটারজুড়ে গড়ে উঠেছে বর্জ্যস্তূপ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেটের নিচ থেকে তরল বর্জ্যের স্রোত নামছে নদীতে। লালবাগ ও ইসলামবাগ-সংলগ্ন লোহারপুল এলাকায় আক্ষরিক অর্থেই ভাগাড় হয়ে আছে বুড়িগঙ্গা। ২০১০ সালে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের মোট ৪ কিলোমিটার নৌপথ থেকে ৯ লাখ ৬০ হাজার ঘনমিটার বা ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন বর্জ্য উত্তোলনের যে কাজ হয়েছিলো তার কোনো ছাপও এখন আর নেই।
বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা ঠেকাতে নদীর তীরে পুলিশ মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। ওই নির্দেশ কার্যকর না করায় আদালত আবার কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কর্তৃপক্ষের প্রতি।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘বুড়িগঙ্গার দখল-দূষণ রোধে কোনো পদক্ষেপই বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না। এরই মধ্যে আমরাও বুড়িগঙ্গা ঘুরে দেখেছি। নদীতে এক ধরনের ফেনা ভাসে, এটা আরো ভয়ের ব্যাপার।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান ড. মো. শামছুদ্দোহা খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ২৫৭টি তরল বর্জ্য লাইনের তালিকা আছে। দুই মাসের মধ্যে এই বর্জ্যমুখগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নোটিশ দিয়েছি। নিজেরা না করলে আমরাই এগুলো বন্ধ করে দেব।’
স্থানীয় বাসিন্দা লাল মিয়া বলেন, কামরাঙ্গীর চরে প্রায় সাত লাখ মানুষের বসবাস। নিরুপায় হয়ে এলাকার মানুষ ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলে। সবুর মিয়া নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, গত বছর পানি যেমন কালো ছিল, এবার তার চেয়ে বেশি কালো ও ঘন মনে হচ্ছে। গন্ধও আরো বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, হাজারীবাগে ২০০ ট্যানারি বা চামড়া শিল্প রয়েছে। এসব ট্যানারিতে কমপক্ষে ৩০ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন ২২ হাজার কিউবিক মিটার বিষাক্ত তরল বর্জ্য যায় বুড়িগঙ্গা নদীতে। আর কঠিন বর্জ্য হয় ১০০ টন। এখানে মাত্র ৩০টি ট্যানারির ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে।
বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা কয়েকটি শিল্প-কারখানার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। কয়েকটিকে নোটিশ দিয়েছে। আমাদের আইনগত পদক্ষেপ চলছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ৪.৫-এর নিচে ডিও লেভেলের পানি জীববৈচিত্র্যের জন্য উপযুক্ত নয়। বুড়িগঙ্গার পানির দূষণের মাত্রা তেমন বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপন করা হয়নি। মামলা করেও কোনো ফল হচ্ছে না। অনেকে ইটিপি স্থাপন করলেও তা চালু নেই।
বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপের ফলে বুড়িগঙ্গায় এখন জীববৈচিত্র্যের জন্য নিরাপত্তা ফিরে আসছে। ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গায় শুশুক জাতীয় প্রাণী দেখা গেছে। যদি পানি খুব বেশি বিপজ্জনক থাকত তাহলে শুশুক থাকার কথা নয়।’
এদিকে নদীর সীমানা নির্ধারণী যে পিলার স্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়েও এলাকাবাসীর নানা অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক স্থানে স্থাপনা বাঁচিয়ে পিলার স্থাপন করা হয়েছে। কোথাও নদীর ভেতরে পিলার বসানো হয়েছে। সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে নদীর প্রকৃত প্রশস্ততা। এসব নিয়ে বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান নিজেও বেশ ক্ষুব্ধ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘পিলার স্থাপন নিয়ে অভাবনীয় অনিয়ম হয়েছে। তাই আমরা পুনরায় পিলার স্থাপন করব। এ ক্ষেত্রে সিএস ম্যাপ অনুসারে আবার মাপ দেওয়া হবে।’
সূত্রঃ দৈনিক কালেরকণ্ঠ, ৩০,০৩,২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics