ছেঁড়াদ্বীপে দু’দিন : পর্ব-১
দিব্য কান্তি দত্ত
নাহ! ক্লাস পরীক্ষার চাপে হাঁসফাঁস অবস্থা পুরো। একটু অন্য আবহাওয়া, অন্য জায়গার হাওয়া-বাতাস দরকার। ঘোরাঘুরি তো অনেক হয়, কিন্তু সময় নিয়ে মনের মতন হা করে সৌন্দর্য গেলা হয়না অনেকদিন। যেই ভাবা, সেই কাজ। হুট করেই প্ল্যান হয়ে গেল জ্যোৎস্নাশোভিত দুটো রাত সেইন্টমার্টিনে সাগরের ধারে বসে কাটাবো। ২৩ মার্চ রাতে রওনা হয়ে গেলাম। টেকনাফ পৌঁছাতে প্রায় ১২ ঘন্টার ধকল গেল বাসে। চট্টগ্রামের পর থেকে বাস দুপাশে জঙ্গল রেখে জ্যোৎস্নার আলোয় পরিপূর্ণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছুটে চলল। জানালার ধারে বসে দৃশ্যটা উপভোগ করাটা মন্দ ছিলনা। তখনও কি জানতাম, কি সব নৈসর্গিক দৃশ্য আর অমূল্য কিছু সময় অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য…
সকাল সাড়ে সাতটায় টেকনাফ পৌঁছানো গেল। পৌঁছেই জাহাজের খবর নিতে ছোটা। এখন মোট ছয়টা জাহাজ ছাড়ে সেইন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। ‘এলএসটি কুতুবদিয়া’য় টিকিট করে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নেয়া গেল। সাড়ে নয়টায় জাহাজ ছাড়ল ঘাট থেকে। নাফ নদী থেকে ঘন্টাখানেক পর সমুদ্রে প্রবেশ করল জাহাজ। একপাশে মায়ানমার দেখা যাচ্ছিল তখন। কখনো নীল, কখনো জলে সবুজ আভা মিলিয়ে অসাধারণ কিছু দৃশ্য দেখা গেল। দারুণ বাতাসের সাথে চিপস খাওয়ার জন্য পিছনে ছুটে আসছিল গাংচিলের দল। চিপস ছোড়াছুড়ি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ খেলা করা গেল ওদের সাথে। চিপস খাওয়ানো গেল, অনেক মজা করাও গেল; কিন্তু কিছু মানুষের নির্বুদ্ধিতায় মনটাই খারাপ হয়ে গেল। জাহাজের অনেক মানুষই চিপসের প্যাকেট আর পানীয়ের বোতল ছুড়ে মারছেন পানিতে। কিছু মানুষকে থামানো গেলেও অন্যান্য তলায় থাকা লোকদের থামানোর সুযোগ হলনা।
সেইন্টমার্টিন দ্বীপটা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেছিল কিছু আরব বণিক। পরবর্তীতে তারা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাহাজে বাণিজ্য করার জন্য দীর্ঘভ্রমণের ক্লান্তি ঘোচাতে বিশ্রামের জন্য বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশের এই দ্বীপটি ব্যবহার শুরু করে। তখন তারা এর নাম রেখেছিল ‘জাজিরা’। ১৮৯০ সালের দিকে রাখাইন সম্প্রদায়ের কিছু লোক এখানে বসতি স্থাপন করতে আসে এবং ধীরে ধীরে তা পরবর্তীতে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘সেইন্টমার্টিন’। এর স্থানীয় নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’। ধারণা করা হয়, খাবার পানির অপ্রাপ্ততার কারণে তৃষ্ণা এবং ক্লান্তি দূরীকরণের জন্য সেখানকার অধিবাসীরা প্রচুর নারিকেল গাছ রোপন করেছিল যার ফলে পরবর্তীতে এই দ্বীপ নারিকেল গাছ প্রধান দ্বীপে পরিণত হয়। দ্বীপের গড় আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার বা ৫ মাইল যার আয়তন ভাটার সময় বেড়ে ১০ বর্গকিলোমিটারের বেশি পর্যন্ত হয় এবং জোয়ারের সময় কমে ৩.৫ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি নেমে আসে। দ্বীপের প্রস্থ স্থানভেদে ৭০০ মিটার থেকে ২০০ মিটার পর্যন্ত।
দুপুর বারোটা নাগাদ পৌঁছুলাম সেইন্টমার্টিন। জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর পর প্রথম ভিউটা খুব একটা নজর কাড়তে পারলনা। অনেক পর্যটক গিজগিজ করছে। যে কারণে জাহাজ থেকে নামতেও বেশ হ্যাপা পোহাতে হল। পাথরের জেটি থেকে সোজা রাস্তা একটা বাজারের ভিতর চলে গেছে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের ভিতর গিয়ে ভ্যান ভাড়া করলাম। এবার রিসোর্ট খোঁজার পালা। পর্যটকে গিজগিজ করা এলাকা থেকে বাঁচতে রিসোর্ট খোঁজার জন্য একটু ভিতরের দিকে যাওয়া হল। যেতে যেতে চোখে পড়া ভিতরের চারপাশের পরিবেশ ব্যাখ্যা করল, দ্বীপের ভিতরের অঞ্চল আর দশ-বারোটা সাধারণ গ্রামের মতনই। ভিতরে মনের মতন রিসোর্ট না পাওয়াতে আবার বাজারের দিকেই ফিরে আসতে হল। আশ্রয়স্থল হল ‘ব্লু মেরিন’ রিসোর্ট। মাঝখান থেকে ওই বিধ্বস্ত অবস্থায় গ্রামের ভিতর ঘোরা হয়ে গেল এবং অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম, ব্যাঙের ছাতার মতন সেখানে শ’য়ে শ’য়ে রিসোর্ট গড়ে উঠেছে যে রিসোর্টের প্রভাব আশেপাশের পুরো পরিবেশকেই কৃত্রিম বানিয়ে ছেড়েছে।
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর ক্লান্ত শরীরে একটা ঘুম দিয়ে নেয়া গেল। ওখানকার মানুষগুলোর সহজ-সরল আচরণ মন কাড়ল। বিকেলে নীল জলে কিছুক্ষণ ঝাপাঝাপি করা গেল। কি স্বচ্ছ আর পরিষ্কার! হাঁটু জলেও নিচে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কক্সবাজারের যাচ্ছেতাই অবস্থার কথা ভেবে মনটা কিছুটা খারাপ হল। সন্ধ্যায় সমুদ্রের তীরে বসা হল সবাই মিলে। আহ! কি দূর্দান্ত! জ্যোৎস্না এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল বালুর বুকে আর বালু চিকচিক করছিল। অদূরে সম্ভবত জেলেদের মাছ ভাগাভাগি চলছিল। পরিষ্কার আকাশ, বালুতে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ চারপাশের নিরবতা ভেঙে দেয়া সমুদ্রের গর্জন আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের পা ভিজিয়ে দিয়ে যাওয়া। ওহ, অসাধারণ, অদ্ভূত, অসহ্য সুন্দর! ঢেউ নিশ্চুপ হয়ে গেলে বাতাসের হু হু শব্দ হৃদয় চিরে সৌন্দর্যের প্রতি এই কাঙালের তাড়না হয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল।
এই সেইন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল রয়েছে। প্রবাল হল ‘নিডারিয়া’ পর্বের ‘অ্যান্থোজোয়া’ শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। প্রাথমিক অবস্থায় সমুদ্রের তলদেশে তাজা প্রবালগুলো খুব নরম এবং মোলায়েম থাকে। পরবর্তীতে এগুলো যখন পানির ওপরে ভেসে উঠে রৌদ্রের তাপ পায় তখন তা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে পাথরের আকৃতি ধারণ করে। এই প্রবালগুলো এক জায়গায় জমা হওয়ার পর তার ওপর ধীরে ধীরে বালির আস্তরণ জমতে জমতে সেইন্টমার্টিনের সৃষ্টি। ভূতত্ত্ববিদদের মতে অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় প্রবাল দ্বীপ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কঠিন লড়াই করে টিকে থাকতে সক্ষম। সেইন্টমার্টিনে প্রায় ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর এবং ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। নারিকেল গাছ, কেয়া গুল্ম আর সবুজ বনানী এই দ্বীপকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
জ্যোৎস্নার অপরূপ সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে করতে হুট করেই চাঁদের আলোয় ফুটবল খেলার ভূত চাপল। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় সবাই মিলে একদফা ম্যাচ হয়েই গেল। এসব অমূল্য আনন্দ আসলে খুব কমই কপালে জোটে। পরদিন সকালে রওনা হওয়া গেল ‘ছেঁড়াদ্বীপ’র উদ্দেশ্যে। গানবোটে করে আধঘণ্টার একটা যাত্রা। প্রবালের কারণে গানবোট দ্বীপের একদম কাছে যেতে পারলনা। অতএব, বাকি সামান্য পথ নৌকায়। বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউ মিলে নৌকাকে দোলনার মত দুলিয়ে দিয়ে গেল। একটু বেশিই কিনা, তাই ধার দিয়ে দুই চারবার জল উঠে পড়ল নৌকায়। ছেঁড়াদ্বীপে পা রাখতেই সৌন্দর্য্য আমায় গেঁথে দিল একজায়গায়। সেজন্যই কিনা একজায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কেয়া গুল্ম, নিশিন্দার ঝোপ আর নারিকেল গাছ দিয়েই ভরা ছোট্ট দ্বীপটা।
ছেঁড়াদ্বীপের বাকি সময় কেমন কাটল আর সেইন্টমার্টিনে ফিরে নতুন কি অভিজ্ঞতা হল এবং বর্তমান পরিস্থিতি আর গবেষকদের মতামত নিয়ে কি শঙ্কায় পেয়ে বসল তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা নাহয় পরবর্তী পর্বের জন্যই রইল…