নাইট্রোজেন চক্রের কথকতা, পর্ব-১
দিব্য কান্তি দত্ত
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর যখন মানুষের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিন্তু ‘কার্বন চক্র’ই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কাড়বেনা ই বা কেন বলুনতো? অন্যান্য দিকগুলো নাহয় বাদই দিলাম; এই যে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, এর জন্য তো কার্বন চক্রের সাম্যবস্থার বিপর্যয়ই দায়ী। কলকারখানা, গাড়ি, নিউক্লিয় চুল্লী থেকে রান্নাঘরের চুলা- কার্বন চক্রের বারোটা বাজাতে কারোরই অবদান কম নয়। কিন্তু, এই বিপর্যয়ে সব দৃষ্টি যদি কার্বন চক্র একা কেড়ে নিয়ে থাকে তবে ওদিকে নিরবে-নিভৃতে কিন্তু ধ্বস নামিয়ে দিচ্ছে ‘নাইট্রোজেন চক্র’! আপনি তেমন একটা চিন্তিত না হলেও কিন্তু আপনার কর্মকান্ডের কারণে নাইট্রোজেন চক্রে সৃষ্ট সাম্যবস্থার বিপর্যয় আপনারই ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
পৃথিবী থেকে শুরু করে বায়ুমন্ডল পর্যন্ত একটা নিয়ত চক্রের মাধ্যমে নাইট্রোজেন বিভিন্ন রাসায়নিক রূপে পরিবর্তিত হয় এবং পুনরায় আগের রূপে ফিরে আসে, এটাই মূলত নাইট্রোজেন চক্র নামে পরিচিত। বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার দ্বারা এ চক্র পরিচালিত হয় যার মধ্যে ঘনীভবন বা মজুদ, অ্যামোনিফিকেশন, নাইট্রিফিকেশন এবং ডিনাইট্রিফিকেশন অন্তর্ভূক্ত। মানবজীবনের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ এই নাইট্রোজেন চক্র।কারণ, প্রাথমিক উৎপাদন এবং পচন এই চক্রের ওপর নির্ভরশীল।
প্রাথমিক উৎপাদন যার ওপর পুরো বিশ্ব নির্ভরশীল, তার ওপর নাইট্রোজেন চক্রের প্রভাব থেকেই আমাদের জীবনে এর গুরুত্ব বোঝা যায়। কিন্তু বিগত কয়েক দশকের প্রেক্ষাপটে শিম কিংবা কলাই জাতীয় শস্যের অধিক উৎপাদন, শস্যক্ষেত্রে নাইট্রেট সার ব্যবহার, হেবার-বস প্রক্রিয়ার ব্যাপক প্রচলন, যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পকারখানা, প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সারের ব্যবহার প্রভৃতি থেকে অক্সাইডরূপে নির্গত নাইট্রোজেন প্রতিনিয়ত নাইট্রোজেন চক্রের অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে চলেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুধুমাত্র যদি কৃষিক্ষেত্র বাদ দেই তবে নাইট্রেট নির্গমনে অন্যান্য ক্ষেত্রের ভূমিকা মাত্র ২০ শতাংশ বা তার কম! এদের মধ্যে ৬ শতাংশ সরাসরি যোগ হয় পানির বিভিন্ন উৎসে এবং বাকি ১৪ শতাংশ মজুদ হয় বায়ুমন্ডলে। অর্থাৎ, নাইট্রেট নির্গমনের দ্বারা চক্রে বড়সড় একটা গন্ডগোল সৃষ্টি করছে কৃষিক্ষেত্র! বায়ুমন্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনমাত্রা বৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখছে রাসায়নিক সার, জৈববস্তুপুঞ্জের দহন এবং গৃহপালিত পশুগুলোর পুষ্টিসংক্রান্ত প্রক্রিয়া।
১৯৯৫ সালে আমেরিকার কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য উৎপাদকেরা পরিবেশে ৩৬ বিলিয়ন পাউন্ড নাইট্রোজেন যোগ করেছিলেন! এর ভিতর ২৩ বিলিয়ন পাউন্ড ছিল নাইট্রোজেন সার থেকে উৎপন্ন এবং বাকি ১৩ বিলিয়ন পাউন্ডের উৎস ছিল জৈব সার। ধারণা করা হয়েছিল যে, এর মধ্যে ৭ বিলিয়ন পাউন্ড শস্যে উৎপাদনে কোন কাজেই আসেনি! এর ফলাফলস্বরূপ, এগুলো নদী, পুকুর, ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে এগুলোকে দূষিত করেছিল। সেবার শুধুমাত্র গম এবং ভূট্টা উৎপাদনের জন্যই ব্যবহার করা হয়েছিল ২৩ বিলিয়ন পাউন্ড নাইট্রোজেন সার যা ৫০ বছর আগের প্রায় ২৫ গুণ! এই নিরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, কৃষিভূমিতে প্রতি বর্গমাইলে নাইট্রেট দূষণের পরিমাণ ছিল ০.৯৩ টন যেখান তা শহর এলাকায় ছিল ০.৫৪৭ টন। বনাঞ্চল এবং বৃক্ষভূমিতে এই পরিমাণ ছিল আরো কম যা প্রতি বর্গমাইলে যথাক্রমে ০.২৬ এবং ০.০৩ টন।
সমীক্ষা থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে, কৃষিভূমি শহরাঞ্চলের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি নাইট্রেট নির্গমন করে যা দূষণের জন্য দায়ী। এছাড়া ভূট্টা এবং সয়াবিন উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কৃষিভূমি বৃক্ষাঞ্চলের চেয়ে প্রায় ১১ গুণ নাইট্রেট নির্গমন করে।সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে কয়েক বছরের ভিতরেই আমেরিকাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় যাতে নাইট্রেট সার ব্যবহারের নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু এতকিছুর পরেও ২০১০ সালে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, নাইট্রোজেনের ফলে সৃষ্ট দূষণের ৯৩.৭ শতাংশের জন্যই দায়ী কৃষিক্ষেত্র! কেন? এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন ‘কলোরাডো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়-এর গবেষকেরা। মূল কারণ এবং গবেষণা থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা থাকছে পরের পর্বে…