খয়রামাথা শুমচা : নিরালার বর্ণালি পরিযায়ী

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

শরীরে তার দৃষ্টি কাড়া রঙের আলপনা। এক কথায় রঙের বিন্যাসে নান্দনিক পাখি। স্বনামধন্য পাখি গবেষক শরীফ খান এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তার শরীরে আছে মোট ১৭ টি রঙের আশ্চর্য-সুন্দর শৈল্পিক কারুকাজ। উড়লে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে রংধনুর সাতটি রঙের ঝলমলে আভা।’ পাখিটি লাজুক ও নিভৃতচারী।মানুষের আগমনসহ অপ্রত্যাশিত কোনো কিছুর উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। মুহূর্তেই হাওয়া পাতার ফাঁকে কিংবা ডালের আড়ালে।এ কারণেই হয়তো অনেকেরই দেখা হয়নি এই অপূর্ব সুন্দর পরিযায়ী পাখিটি। কিছুটা সময় এরা আমাদের দেশে কাটিয়ে ডানায় ভর করে আবার ফিরে যায় অন্যকোনো দেশের নিভৃত স্থানে।পাখিটির ইংরেজি নাম Hooded Pitta এবং Pitta sordida। এই পাখির অন্য বাংলা নামগুলো হলো হালতি, রুমালমাথা শুমচা ও নীলফক্কি।

Hooded Pitta Pic-1

বরেণ্য পাখি গবেষক, আলোকচিত্রী ও বনবিভাগের কর্মকর্তা মুনির আহমেদ খান বলেন, ‘পাখিটির নাম খয়রামাথা শুমচা আমাদের দেশে এরা গরমকালের পরিযায়ী পাখি। শীতকালে এরা হিমালয় এলাকায় থাকে। এরা নিভৃতেই বিচরণ করে। চট্টগ্রামের পাহাড় এবং সিলেটের বিভিন্নবনে এরা ঘুরে বেড়ায়।আমি মধুপুরে ও এই প্রজাতির পাখি দেখেছি। চওড়া পাতাযুক্ত চিরসবুজ বন কিংবা পাতাঝরা বনের বাসিন্দা এরা। অল্পসংখ্যায় এরা আমাদের দেশে আসে। ১৫, ২০ বা ৩০টি।এই অনুপাতে লাউয়াছড়ায় আমি এদের দেখেছি ।এদের মাথাটা কালো ।মাথার ওপরের অংশ গাঢ় খয়েরি ।লালচে বাদামি-জলপাই রঙের আভা ছড়ানো।পেটের নিচের দিকটা গাঢ়লাল ।বুক-পেট সবুজ। ঘাড়-গলা-ঠোঁট কালো। চোখ কালচে বাদামি। ডানার ওপরের অংশ হালকা নীল। দৈর্ঘ্য ১৯ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৬৫গ্রাম।এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এদের প্রজননকাল । সাদা রঙের চার থেকে পাঁচটি ডিমপাড়ে ।মেয়ে-ছেলে উভয় পাখি পালা করে ডিমে তা দেয়।’

মুনির আহমেদ আরো বলেন, ‘এই খয়রামাথা শুমচা পাখির ছবিটি আমি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে তুলেছি ।মাটি থেকে এরা আড়াই-তিন ফুটের মধ্যেই বিচরণ করে। বেশি ওপরে ওড়াউড়ি করেনা । ভেজা মাটি বা ভেজা বনতল এদের প্রিয় আবাস।এরা দেড় থেকে দুইশ বর্গমিটার এলাকায় বিচরণ করে । তবে ওই এলাকা অবশ্যই এদের খাদ্যে পরিপূর্ণ থাকতে হবে ।প্রজনন মৌসুমের সময় নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে এরা কোথাও যায়না।এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে নানাজাতের কীটপতঙ্গ ।এরা অন্য পরিযায়ীদের সঙ্গে মেশেনা ।আলাদা নিভৃতে ঘুরে বেড়ায়।’

মুনির খান আরো বলেন, ‘মজার ব্যাপার হলো, এরা বাংলাদেশে এসে ডিম পাড়ে এবং ছানা ফোটায় ।এপ্রিলে আসে, সেপ্টেম্বরে ফিরে যায়।আমাদের দেশে এরা চার থেকে পাঁচ মাস অবস্থান করে। এসেই এরা সন্তান উৎপাদনের জন্য পাগল হয়ে যায়। প্রচণ্ড ডাকাডাকি করে তখন।বাঁশঝাড় কিংবা নিচুগাছের গোড়ায় ঘাস ও পাতা দিয়ে বাসা করে।ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বএশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে ।পৃথিবীতে ৩০ টি প্রজাতির Pitta বা শুমচা থাকলে ও আমাদের দেশে এই পাখির মোট পাঁচটি প্রজাতির দেখা মেলে।এদের মধ্যে দুই প্রজাতি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি এবং অবশিষ্ট তিন প্রজাতি হলো পরিযায়ী পাখি।’

 বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক,

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ

এবং

স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট

বাংলানিউজটুয়েন্টিফোর.কম

biswajit.bapan@gmail.com

সূত্র: ৯ এপ্রিল২০১৪ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading