দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র আট বছর ধরে বিকল

1_9375
ইসমাইল আলী ও জহিরুল হক
দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র  ২০০৫ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ফেনীর সোনাগাজীতে। তবে উত্পাদন শুরুর পর পরই তা বিকল হয়ে পড়ে। এরপর প্রায় আট বছর কেটে গেলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়নি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। অযত্ন-অবহেলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। অথচ সৌর ও জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
সমুদ্রসৈকত থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সাগর মোহনা সোনাপুর গ্রামে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৯০০ কিলোওয়াট উত্পাদনক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় হয় ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উত্পাদনও শুরু হয়। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ার, জেনারেটর, কন্ট্রোল প্যানেল, সাবস্টেশন, ব্লেড, ম্যাচিং গিয়ার এলিমেন্ট স্থাপনসহ প্রায় ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ারের মাথায় দেড় টন ওজনের পাখা বসানো হয়। যাতায়াতের জন্য মুহুরী সেচ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত সড়কও নির্মাণ করা হয়। কেন্দ্রটি পরিচালনায় স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে ১১/০.৪ কেভি লাইনের একটি সংযোগ টানার পাশাপাশি টু-ওয়ে মিটারও স্থাপন করা হয় উত্পাদিত বিদ্যুৎ কেনাবেচার জন্য।
এক্ষেত্রে বাতাসে বিশাল আকৃতির পাখা ঘোরার মাধ্যমে ৯০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারের। কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, চীনের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার আর ভারতের অদক্ষ ঠিকাদারের কারণে পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঠিকাদার ছিল ভারতের নেবুলা টেকনো সলিউশন্স লিমিটেড।
সোনাগাজী বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের তত্কালীন প্রকল্প পরিচালক খিজির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পিডিবির সাবেক সদস্য (জেনারেশন) আবুল কাশেম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পুরোদমে উত্পাদনে যাওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। মূলত নির্মাণ ত্রুটির কারণে পরীক্ষামূলক উত্পাদনের সময়ই এটি বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ায় ঠিকাদারকে পুরো বিল পরিশোধ করা হয়নি।
বায়ুবিদ্যুতের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও কেন্দ্রটি মাত্র এক মাস চালু ছিল। ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সভাপতি আবদুল মোতালেব জানান, চালু অবস্থায় সর্বোচ্চ উত্পাদন রেকর্ড হয় ২৫০ কিলোওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। টাওয়ার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশে মরিচা ধরেছে। অযত্ন-অবহেলায় এটি নষ্ট হওয়ার পথে। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখার জন্য প্রকল্প এলাকায় কোনো সীমানাপ্রাচীরও নেই।
কেন্দ্রটি পুনরায় চালুর ব্যাপারে সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি উল্লেখ করে আবুল কাশেম জানান, পরীক্ষামূলক উত্পাদনের সময় বন্ধ হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রটি চালু করার বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাতাসের গতিবেগ অনেক কম হওয়ায় এটি চালু করে ভালো ফল পাওয়া যাবে না বলে কেন্দ্রটি নিয়ে কোনো নতুন পরিকল্পনাও নেই।
তবে এ বিষয়ে একমত নন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম। তিনি বলেন, বায়ুচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে পিডিবির সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। সংস্থাটিতে এ-সংক্রান্ত একটি সেল থাকলেও তা খুব বেশি শক্তিশালী নয়। পিডিবি দাতা সংস্থার তহবিল পাওয়ায় ২০০৪ সালে বায়ুচালিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করে। কিন্তু তা রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের মতো কোনো তহবিল সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আর চালু হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে বায়ুচালিত বিদ্যুৎ বড় ধরনের উত্স হতে পারে বলে মনে করেন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতউল্লাহ। তার মতে, জল ও সৌরবিদ্যুতের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উত্স হতে পারে এ খাত। এক্ষেত্রে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত ও আশপাশের ২৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সহজেই বায়ুচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। এর মাধ্যমে বিদ্যুতের বড় ধরনের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, বায়ুচালিত বিদ্যুতের সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করে আবারো এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদনও দেয় সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এ বিদ্যুৎ প্রকল্পে যৌথভাবে বিনিয়োগ করছে দেশী প্রতিষ্ঠান টেলর ইঞ্জিনিয়ারিং ও মার্কিন কোম্পানি পিএইচ কনসালটিং ইনকরপোরেশন।
সূত্রঃ বণিক বার্তা ২০/০৭/২০১৩

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading