ছেঁড়াদ্বীপে দু’দিন : পর্ব-২

দিব্য কান্তি দত্ত 

‘ছেঁড়াদ্বীপ’ মানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সেইন্টমার্টিনের আশেপাশে এমন দ্বীপের সংখ্যা অনেক। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিকটতম দ্বীপে যাতায়াত সহজ হওয়ার কারণে পর্যটকদের কাছে এর পরিচিত বেশি এবং এই নিকটতমটিই ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়রা যেহেতু ‘দ্বীপ’কে ‘দিয়া’ ডাকে, সেহেতু ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ স্থানীয়ভাবে ‘সিরাদিয়া’ বা ‘ছেঁড়াদিয়া’ হিসেবেও পরিচিত।  ছেঁড়াদ্বীপও প্রবালগুচ্ছ এবং ঝিনুক, শামুকের খোলস ও চুনাপাথরে তৈরি কোকুইনা স্তর দিয়ে গঠিত। বলতে ভুলে গেছিলাম, সেইন্টমার্টিনেও কিন্তু এই কোকুইনা স্তর বিদ্যমান। ছেঁড়াদ্বীপকে অবশ্য সেইন্টমার্টিন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন বলা যাবেনা। ভাটার সময়ে পানি নেমে গেলে সেইন্টমার্টিন এবং ছেঁড়াদ্বীপের সংযোগকারী পথ জেগে ওঠে যে পথে রয়েছে অসংখ্য প্রবাল পাথর। তাই ভাটার সময় হেঁটেই ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া সম্ভব। নিঃশব্দতা আর নির্জনতায় পরিপূর্ণ এ দ্বীপের সৌন্দর্য্য অভাবনীয়। সুপেয় পানির অভাবে সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। কেয়া, নিশিন্দা, সাগরলতা আর ছোট ছোট খাঁড়িতে আটকে পড়া রঙিন মাছ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া আর জীবিত কিংবা মৃত প্রবালই এ দ্বীপের বাসিন্দা। পর্যটকদের ক্ষুধা আর তৃষ্ণা মেটানোর জন্য দেখা মিলবে একমাত্র দোকানের যেখানে মিলবে ডাবের পানি, মিনারেল ওয়াটার আর হালকা কিছু খাবার-দাবার।

Keya_Tree_of_Saint_Martin_Island

নেমে দ্বীপের মাঝখানে কিছুটা ঘুরেই সবাই মিলে সমুদ্রে নেমে পড়লাম। পানিতে নিমজ্জিত প্রবালের ওপর হেঁটে চলা খুবই বিপজ্জনক যে কারণে প্রায় সবারই পায়ে সামান্য হলেও কেটে গেল। সমুদ্রে ঝাপাঝাপি করে কখন ঘড়ির কাটা ছুটে দেড়টা বেজে গেল বুঝতেই পারলাম না! দুইটায় গানবোট ফিরে আসার কথা সেইন্টামার্টিনে ফিরিয়ে নিতে। উপায়ান্তর না দেখে দৌড়াতে শুরু করলাম ওইটুকু সময়ে দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য। সমুদ্রের তীর ঘেষে কিছুক্ষণ দৌড়ে একটু ভিতরের দিকে ঢুকতেই চোখে পড়ল লতাগুল্ম আর বুনোঝোপের মাঝে শ্যাওলা সবুজ জলাশয়। দুটো বাজতে মিনিট দশেক বাকি থাকতেই ফিরে এলাম। ছোট দ্বীপটা পুরোটা ঘুরে ফেলার জন্য আধঘন্টা যথেষ্ঠ সময়। জোয়ার ঠিকমত শুরু হওয়ার আগেই ফিরে গেলাম গানবোটে। আর কিছুক্ষণ দেরী করলে হয়ত সমুদ্রের বিশাল জলরাশির ধাক্কায় ভয়ংকর দুলুনি খেতে খেতেই ফিরতে হত সেইন্টমার্টিন।

আড়াইটা নাগাদ সেইন্টমার্টিনে ফিরে আসা হল। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরেই আবার সমুদ্রের তীরে ছোটা। ভেসে আসা ঝিনুক, শামুক আর কড়ি কুড়িয়েই আবার সমুদ্রে নেমে পড়া। গলা পর্যন্ত সমুদ্রে শরীর ডুবিয়ে দেখা হল জীবনের প্রথম সূর্যাস্ত। এরচেয়েও সুন্দর সূর্যাস্ত হয়, তবে এমন মূহুর্ত খুব একটা পাওয়া যায়না। রাতে বাজার ঘুরতে বের হলাম। প্রায় দশ হাজার বাসিন্দার সেইন্টমার্টিনে মৎস্যজীবী লোকের সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। “বাদবাকিদের জীবিকা কি?”- এই প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি বাজারটা ঘুরে ফেললেই পাওয়া যায়। অনেক ধরনের দোকানের মধ্যে মুদি দোকান হাতে গোণা দু-চারটে। শাক-সবজি থেকে শুরু করে ডিম, আটা-ময়দার প্যাকেট থেকে শুরু করে মুরগী- এদের সমস্ত মালামাল আমদানি করতে হয় টেকনাফ থেকে। এই মালামাল আসে জাহাজ কিংবা নৌকায় এবং যারা এই মালামাল বহন করে সেটা তাদের জীবিকা। বাদবাকি দোকানের ভিতর দেখা যাবে শুটকির আড়ৎ। সেখানে রয়েছে টুনা মাছ, রূপচাঁদা, করাত মাছ থেকে শুরু করে ফ্লাইং ফিশের মত বিভিন্ন মাছ। অধিকাংশ দোকানেই বিক্রি করা হচ্ছে শামুক, ঝিনুকের অলঙ্কার; অনেকগুলো দোকানে বিক্রি হচ্ছে মায়ানমার থেকে আমদানি করা আঁচার এবং বাদামের ক্যান্ডি। আশেপাশে গড়ে উঠেছে হরেক রকমের হোটেল। এসব হোটেলে খাবারের দামের যেমন হেরফের তেমন হেরফের খাবারের মানেও।

বাজার ঘুরে প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা শেষে রিসোর্টে ফেরা বার্বিকিউয়ের জন্য। চাঁদনী রাতে অসাধারণ একটা বার্বিকিউ পার্টি শেষে সমুদ্রের তীরে সবাই মিলে গীটার নিয়ে গানের আসরে বসা। ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোতে ভিজে প্রত্যেকে বুঁদ হয়ে গেলাম সঙ্গীতে। রাতটা কাটল অসাধারণ! পরদিন দুপুর তিনটায় জাহাজে করে ফিরতে হবে টেকনাফ। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম পুরো দ্বীপ ঘুরতে। সাইকেল ভাড়া করে ছোটা হল গ্রামের ভিতর দিয়ে। চোখে পড়ল সেইন্টমার্টিনের একমাত্র স্কুল এবং কলেজ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় কোন শিক্ষার্থী দেখা গেলনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রায় আড়াইশ বাচ্চাকাচ্চার লেখাপড়া চলছে সেখানে। নামে স্কুল এন্ড কলেজ হলেও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্তই পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। স্কুল থেকে বের হয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ল দশ শয্যা বিশিষ্ট সেইন্টমার্টিনের একমাত্র হাসপাতালটি। আশেপাশে তেমন কোন লোকজন না দেখে বোঝা গেল, নামে হাসপাতাল হলেও সুযোগ সুবিধা তেমন একটা নেই। গ্রামের ভিতর দিয়ে ঘুরে বেড়াতে আরও চোখে পড়ল শ্বাসমূল অঞ্চল, ধানক্ষেত, প্রবাল তুলে এনে তৈরি করা দারুণ একখানা পুকুর। পুরো দ্বীপে আলাদা করে গ্রাম রয়েছে নয়টির মত।

DSC_0556

দ্বীপে প্রচুর বাচ্চাকাচ্চাকে দেখা যাবে ঝিনুক, শামুকের সাথে বিভিন্ন আকার আকৃতির প্রবাল পাথর বিক্রি করতে। এখান থেকেই সেইন্টমার্টিনের জন্য শঙ্কার শুরু। প্রবালে গঠিত হওয়াই এই দ্বীপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং ঠিক এই কারণেই এ দ্বীপের টিকে থাকার ক্ষমতা অন্যান্য যেকোন সাধারণ দ্বীপের তুলনায় বেশি। দুঃখের বিষয় এটাই, প্রবাল দ্বীপটি বিগত বারো বছরে এর মোট প্রবালের ২৫ শতাংশেরও বেশি হারিয়ে ফেলেছে! এর জন্য অবশ্যই মূলত দায়ী পর্যটকেরা। এভাবে জনবসতি আর পর্যটক অবাধে বাড়তে থাকলে দ্বীপ বিশাল ঝুঁকিতে পড়া অসম্ভব কিছু নয়। সকালে নাস্তা করতে গিয়ে কথা হচ্ছিল দোকানের মালিকের ছোট্ট ছেলে ইউসুফের সাথে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। আগে টেকনাফে নানার বাড়ি থাকত। বাবার ব্যবসায় সাহায্যের জন্য সপ্তাহখানেক আগে সেইন্টমার্টিন এসেছে সে। এভাবে বিভিন্ন কারণে লোকবসতি বাড়তে বাড়তে সেইন্টমার্টিনের বর্তমান জনসংখ্যা বর্তমানে দশ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’র ‘পর্যটন ও ব্যবস্থাপনা’ বিভাগের গবেষণা কিন্তু বলছে অন্য কথা। দ্বীপকে বাঁচাতে হলে এই জনসংখ্যা তিন থেকে চার হাজারে নামিয়ে আনতে হবে। তাতে হয়ত প্রচুর লোকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু দ্বীপকে বাঁচাতে গেলে এর কোন বিকল্প নেই। জরিপ থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, দ্বীপের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ইউসুফের মত বাইরে থেকেই আসা।

IMG_0864

কোন এলাকার পরিবেশের ক্ষতি না করে সেই এলাকায় কত সংখ্যক পর্যটক গ্রহণ করা যাবে তা পরিমাপের একটি পদ্ধতি আছে। একে বলা হয় ‘ট্যুরিজম ক্যারিং ক্যাপাসিটি (টিসিসি)’।  সেইন্টমার্টিন ভ্রমণের প্রধান সময় মূলত নভেম্বর থেকে মার্চ। এই সময়ে সেইন্টমার্টিনে দিনে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার পর্যটক আসছেন। ‘টিসিসি’র হিসাব বলছে, অধিক লোকের চাপে সেইন্টমার্টিন প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে। ‘পর্যটন ও ব্যবস্থাপনা’ বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদুল হাসানের মতে, সংখ্যাটা সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই হাজার হতে পারে। এর বেশি পর্যটকের ভ্রমণ দ্বীপের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।

পরিবেশ ও পর্যটন বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ ফেলার মত আরেকটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানকার হোটেল ও রিসোর্টগুলো। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এসব ইট-পাথরের দালান ধ্বংস করছে দ্বীপটির বাস্তুসংস্থানিক ভিত্তিকে। গবেষকদের মতে, অবিলম্বে সেইন্টমার্টিনে সবধরনের বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। বাস্তুসংস্থানিক ভিত্তি ঠিক রাখতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে হবে কাঠ এবং ছন দিয়ে। টিন এবং ইটের ব্যবহার হতে হবে নূন্যতম। পর্যটন কর্পোরেশনের ‘ন্যাশনাল হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ইনস্টিটিউট’র অধ্যাপক অধ্যক্ষ পারভেজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, “এক্ষেত্রে আমাদের পলিসি হতে হবে ভূটানের মত। ভূটান যেমন ‘রেস্ট্রিক্টেড ট্যুরিজম’ এর নিয়ম মেনে পর্যটন ব্যবস্থা পরিচালনা করছে আমাদেরও তেমনটা করতে হবে। ‘ম্যাস ট্যুরিজম’ সেইন্টমার্টিনের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে”।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল, ১৯৯৭ সালে প্রথম সেখানে ‘সেইন্টমার্টিন রিসোর্ট’ নামে একটি আবাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। পরে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ দুটো ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবস্থা করলে সেইন্টমার্টিনে প্রথম পর্যটক আসা শুরু হয়। তার আগে সেইন্টমার্টিন পর্যটকের যাতায়াত প্রায় ছিলনা বললেই চলে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে সেখানে হোটেল আর রিসোর্ট গড়ে উঠতে থাকে। তবে ইদানিংকালের পর্যটকের আধিক্যই এত বেশি হোটেল এবং রিসোর্ট গড়ে ওঠার প্রধান কারণ।

যাই হোক, অনেক ঘোরাঘুরি হল, অনেকের সাথে কথাও হল। এরপর আবার রিসোর্টে ফেরা হল চেক আউট করার জন্য। এরপর শেষবারের মত সমুদ্রতীরে সবাই মিলে কিছু হৈ-হুল্লোড়ের পালা। কাঠফাটা রোদ্দুরে প্রাণ জুড়ালো সেইন্টমার্টিনের অসাধারণ মিষ্টি ডাবের জল। নিঃসন্দেহে আমার জীবনে খাওয়া সেরা ডাব ছিল। সময় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এল। এবার জাহাজে ওঠার পালা। সামান্য সময়ের অভাবে সমুদ্রের তীরে ঘুড়ি ওড়ানোর ইচ্ছাটাই অপূর্ণ রয়ে গেল একমাত্র। তিনটা বাজতেই জাহাজ জেটি ছাড়তে শুরু করল। জাহাজে মনটা সাথে নিয়ে ওঠা হলনা, ওটা ঐ দ্বীপেই পড়ে রইল। দ্বীপ থেকে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে লাগল হাহাকার, চোখদুটো আঁকড়ে ধরে রইল জায়গাটাকে। বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হল, সঙ্গী হিসেবে এল আবার ফিরে যাওয়ার প্রবল আকুতি। কিছুক্ষণ পরেই দ্বীপ অস্পষ্ট হতে লাগল। মনের হাহাকারগুলো সব একসঙ্গে জড়ো হয়ে বলে উঠল, “ভালো থেকো ‘সেইন্টমার্টিন’, আবার দেখা হবে”।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics