ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি আর গাছগুলো কি বাঁচার অধিকার হারাবে?

তাওহীদ হোসাইন

দুপুরের খাবারের সময়, বিভাগ থেকে বের হয়ে তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে কার্জনের সুপরিচিত জহির ভায়ের ক্যান্টিন থেকে গরম-ঠাণ্ডা কিনে গাছের ছায়ায় সবেমাত্র বসেছি; একাত্তর টেলিভিশন থেকে হোসাইন সোহেল ভায়ের ফোন! জানালেন, ফজলুল হক মুসলিম হলের পেছন দিকে যে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে সেখানে কুঠার চলছে উন্নয়নের পথে!

পড়ি-মরি ছুটলাম, যোগাযোগ করে সাথে নিলাম ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের স্নেহের ছোটভাই রোনেল’কে।

আমি আর রোনেল পুলিশ ফাঁড়ি পৌঁছে এর পেছন অংশে চলে আসি। জায়গাটি মূল সড়ক থেকে চোখে না পড়ায় আমার আগে এখানে আসা হয়ে উঠেনি। এর আরও একটা কারণ হয়তো, এটা পুলিশ ফাঁড়ি তাই। বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়িটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গার উপর অবস্থিত। একসময় এটি তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছথেকে লিজ নেয় পুলিশ কিন্তু চুক্তি ফুরিয়ে যাবার পরে তাঁরা জায়গাটি ছাড়েনি। এখন এই অবস্থায়ই তাঁদের বসবাস ও কার্যক্রম চলছে। মোটামুটি, এক বিঘা জায়গার উপরে এই ফাঁড়ি অবস্থিত।

এবার মূল কথায় আসি, পুলিশ ফাঁড়ির জায়গায় বেশ পুরাতন প্রায় পঞ্চাশ বা আরও অধিক বয়েসি মেহগনি, কড়ই, রেন্ডি কড়ই, গগণ শিরিষ গাছ ছিলো। ছিলো বলছি এই কারণে যে, আজ আমরা গিয়ে দেখেছি, পুলিশ হাউজিং এর নামে ২২ তলা বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ফাঁড়ির পেছনের অংশে। এ উপলক্ষে তাঁরা প্রায় ১০টির বেশি গাছ কেটে ফেলেছে। উন্নয়নের জন্য আমাদের কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং দশ-পনেরোটি গাছ অনেকের কাছে তেমন কোন ইস্যু নয়। কিন্তু, এ গাছগুলো কেন আমাদের ক্যাম্পাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সেই বয়ান জরুরী মনে করছি।

  • ফজলুল হক মুসলিম হলের এক্সটেনশন, একুশে হল, আনোয়ার পাশা ভবন এবং বহুতল বিশিষ্ট আবুল খায়ের আবাসিক শিক্ষক ভবনের সন্নিকটে অবস্থিত এই ঘন গাছের সারি এই এলাকায় বসবাসরত হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক এবং তাঁদের পরিবারের জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেনের উৎস ছিলো। দক্ষিণের বাতাস যখন পুরাতন ঢাকার নানান শিল্পোদগিরিত বিষাক্ত ধোঁয়ার দমকা নিয়ে এই মুখী হতো, এই গাছগুলো সেই বাতাসকে প্রাকৃতিকভাবে ছেঁকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করতো শত বর্গমিটার জুড়ে।
  • ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, জামাল খান স্যার বলছিলেন, এই গাছগুলো ক্যাম্পাসের সবথেকে উঁচু গাছগুলোর মধ্যে ছিলো। প্রায় ৪৫ প্রজাতির পাখির দেখা পেয়েছেন তিনি এসব গাছে; এর মধ্যে বেশকিছু মাইগ্রেটরি বা পরিযায়ী পাখিও আছে। বেশ ক’বছর ধরে তিনি পাখিগুলো পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন। এছাড়া বিখ্যাত নিমতলির টিয়া পাখির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ন্যাচারাল হ্যাবিটেট বা বাসস্থান ছিলো এই গাছগুলো।
  • যারা বিকেলের শেষে কার্জন হল এলাকায় গিয়েছেন বা থাকেন, খেয়াল করে দেখবেন; সন্ধ্যার শেষ আলোর মুহূর্তে শতশত টিয়া পাখি দল বেঁধে ডাকতে ডাকতে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দিক থেকে দক্ষিণে উড়ে যায়, কি যে সুন্দর সে দৃশ্য না দেখলে অনুভব করা যায়না। তাঁরা কোথায় যেতো জানেন? টিয়া পাখি উঁচু গাছ ছাড়া ব্রিডিং বা প্রজনন কর্ম সম্পন্ন করে না। এই গাছগুলো ছিল প্রায় ৫০০ টির অধিক টিয়া পাখির শেষ আশ্রয়স্থল। এখন এই পাখিগুলোর জীবন যেমন বিপন্ন হবে তেমনেই প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্রে বিশাল এক ক্ষত তৈরি হবে, বিপন্ন হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশিষ্ট প্রকৃতি।
  • এছাড়া, শহর এলাকায় প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়া কলা বাদুড় বা ইন্ডিয়ান ফ্লাইং ফক্স এর বিশাল কলোনি ছিলো এই গাছগুলো।
  • মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, এবং তিনি প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করেছেন। তিনি, স্ব-প্রণোদিত হয়ে ঘোষণা করেছেন, উন্নয়নের নামে যেন শতবর্ষী গাছের গায়ে কুঠার না পড়ে। cut trees of DU area

কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের সাথে আজ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হলো, অবৈধভাবে এখনও বিরাজমান পুলিশফাঁড়ির জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের নামে কি করে প্রাণ-প্রকৃতির উপর আঘাত করা হলো। আমরা সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ ভাইদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছিলাম তাঁরা কেন এতোগুলো গাছ কাটলেন? তাঁরা আমতা আমতা করে জানালেন, “ভাই আমরা কিছু জানিনা এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে”!! এছাড়া এই ফাঁড়ির জায়গার এখতিয়ার নাকি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে! অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে ,কবে থেকে এই পুলিশ ফাঁড়ি এখানে রয়েছে এবং চুক্তি কবে শেষ হয়েছে, এই সকল নথিপত্র নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

আমাদের প্রশ্ন থাকলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি। পুলিশ প্রশাসন বলছে, এই জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের দিয়ে দিয়েছে! নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি থাকতে পারে কিন্তু, দুইটি গুরুত্বপূর্ণ হল এবং আবাসিক শিক্ষক ভবনের পাশ ঘেঁষে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে, কি করে পুলিশের জন্য ২২ তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হলো? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার মধ্যে পুলিশের বহুতল ভবন নির্মাণে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে? P_20160330_145603

উঁচুগাছ গুলো সব কেটে সাফ করা শেষ, কাঠগুলোও বিক্রির পথে, যে ক্ষতি আমাদের হলো তা পুষিয়ে নিতে পঁচিশ- ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছর যথেষ্ট নয়। মাত্র তিনটে গগন শিরিষ গাছ এখনও কাটা পড়েনি যেগুলো ফাঁড়ি এবং ফজলুল হক হলের এক্সটেনশন ভবনের সীমানা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই তিনটে গাছকে কি আমরা বাঁচাতে পারি না আমাদের ভবিষ্যতের জন্য?বায়োডাইভারসিটি বা জীব বৈচিত্র্য এখন একটি অধিকার। এটি যেমন প্রাণীর অধিকার তেমনি মানুষের অধিকার। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গাছগুলো কেটে আইনের রক্ষকরা আদতে আইন ভাঙ্গারই প্রখর চর্চায় লিপ্ত হচ্ছেন। শুধু দালান কোঠা আর ইটকাঠে উন্নয়নের সফুল আসে না। “উন্নয়ন দুর্যোগ” নামক মহামারির আঁচর দয়া করে আমাদের এই প্রাণের ক্যাম্পাসের গায়ে লাগতে দেবেন না প্লিজ।

সবশেষে, ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের অভিভাবক উপাচার্য স্যারকে ফোনে জানাই, তিনি বলেন “এ ব্যাপারে আমার সাথে পুলিশ কর্তৃপক্ষের কথা হয়েছে, আমি বলেছি গাছ যেন কাটা না হয় তাঁরা বলেছেন ব্যাপারটি তাঁরা দেখবেন”। স্যার, আপনার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, ওরা গাছগুলো কেটেই ফেলেছে; অবশিষ্ট গুলো যদি সম্ভব হয় বাঁচাবেন আর তাঁরা যে ক্ষতি প্রাণ ও পরিবেশের প্রতি করলো; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি করলো; এর প্রতিকার চাইবেন। ফাঁড়ি বা হাউজিং করার জন্য ওনাদের জায়গার অভাব হবে না, কিন্তু আমাদের একটাই ক্যাম্পাস। সবুজ কমছে, আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে স্যার।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics