ধরিত্রী দিবস জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

ড. মো. খালেকুজ্জামান

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসার কারণে এ শতকের মধ্যেই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশ ডুবে যাবে— কথাটি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। কেউ কেউ এ কথাও বলছেন যে, এ শতকের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল সমুদ্র গহ্বরে তলিয়ে যাবে। যদি সত্যি সত্যি ২০ শতাংশ অঞ্চল ডুবে যায়, তাহলে সেখানে বসবাসরত ৪ কোটি মানুষের ঠাঁই হবে কোথায়? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি বাংলাদেশ ডুবে যাবে? বাংলাদেশ ও এর মানুষকে কি এ মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষার কোনো উপায় নেই? কী কী পদক্ষেপ নিলে এ বিপর্যয়ের গতি রোধ অথবা হ্রাস করা সম্ভব? এসব প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের ওঠানামা বিশ্বের ৪৬০ কোটি বছরের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিগত ৪ লাখ বছরের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যলোচনা করলেই দেখা যাবে— এ সময়ের মধ্যে ১০ বারেরও বেশি জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ ওঠানামা করেছে। ১ লাখ ২৫ হাজার বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠ এখনকার তুলনায় ৬ মিটার উপরে এবং বাংলাদেশের সমুদ্রতটরেখা তখন টাঙ্গাইলের মধুপুর ও রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি অংশ সমুদ্রের নিচে ছিল। অন্যদিকে ১৪ হাজার বছর আগের বরফ যুগে সারা পৃথিবীতে সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় ১০০ মিটার নিচে এবং বাংলাদেশের সমুদ্রতটরেখা তখন বর্তমান অবস্থান থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সমুদ্রতলের অতল খাদের (Swatch of no ground) কাছে অবস্থিত ছিল। অর্থাৎ সে সময়ে বর্তমান বাংলাদেশের আয়তন অনেক বড় ছিল। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ অঞ্চলই নদী প্লাবন ভূমি ও বঙ্গীয় ব-দ্বীপের অংশ, যা কিনা সমুদ্রপৃষ্ঠ ওঠানামা সত্ত্বেও পলি স্তরায়নের মাধ্যমে শুধু টিকেই থাকেনি বরং সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসার তুলনায় পলি স্তরায়নের মাত্রা বেশি ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত সাত হাজার বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠ ৭ মিটার উপরে উঠে এসেছে এবং এ সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশের মধ্য অঞ্চল থেকে শুরু করে বর্তমানের উপকূলীয় অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে নদীর প্লাবন আর জোয়ারভাটা বাহিত পলি মাটির স্তরায়নের পরিমাণ ছিল ৩০ মিটার। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় ভূমির উচ্চতা বেড়েছিল চার গুণ হারে। সমুদ্রপৃষ্ঠ ১০ হাজার বছর ধরেই ক্রমে উপরে উঠে আসছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের ভূমির উচ্চতাও বেড়ে চলেছে। বিগত ২০০ বছরের উপকূলীয় অঞ্চলের মানচিত্র পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রেনেল (Rennell) নামের একজন ইংরেজ প্রথম উপমহাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করেন ১৭৮০ সালে। তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের উপকূলীয় মানচিত্রের তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চল ২০০ বছর ধরে মোটামুটিভাবে একই স্থানে থাকলেও পূর্বাঞ্চলের অনেক জায়গায়ই ভূমির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ভোলা, হাতিয়াসহ বৃহত্তর বরিশাল, নোয়াখালীর অনেক অঞ্চল গত ২০০ বছরে প্রায় ৮০ কিলোমিটার সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসার বার্ষিক গড় হার হচ্ছে ৪-৮ মিলিমিটার। অর্থাৎ একই সময়কালে ভূমির উচ্চতা বাড়ার পরিমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসার চেয়েও বেশি ছিল। এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭৩-২০০০ সময়কালে উপকূলীয় অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে ভূমিক্ষয় হলেও প্রতি বছর গড়ে তা ১৮ বর্গ কিলোমিটার বেড়েছে।
কয়েক দশক ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠ ও ভূমির উচ্চতা বেড়ে ওঠার চিত্রটা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বর্তমানে ভূমিক্ষয় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জলাবদ্ধতার পরিমাণও। বিভিন্ন মিডিয়ার খবর ও মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, যশোরের ভবদহসহ অন্যান্য নিম্ন উচ্চতার উপকূলীয় ভূমি কয়েক দশক ধরে স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৭ সময়কালেই সমুদ্রের নোনা পানি বৃহত্তর খুলনা, যশোর, বরিশাল, নোয়াখালীর অনেক ভেতরে প্রবেশ করে সুপেয় পানি ও কৃষিজমি ব্যবহারের অনুপযুক্ত করে ফেলেছে। অন্যদিকে ২০০৯ সালে সংঘটিত উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস আইলায় ডুবে যাওয়া অনেক অঞ্চল থেকেই সমুদ্রের নোনা পানি আর সরছে না। গত কয়েক দশকে বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি এবং এখানে বসবাসকারী জনগণকে। প্রথমত. উন্নত দেশগুলোর অত্যধিক বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ফলে অনেক বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউস ইফেক্টের জন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে আসার মাত্রা বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশের উজানের দেশগুলোয় অভিন্ন নদ-নদীতে একতরফা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ ও নদীবাহিত পলি মাটি প্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলকে টিকে থাকতে হলে প্রাকৃতিক নিয়মে নদীর প্লাবন ও জোয়ারভাটা বাহিত পলির স্তরায়নের মাধ্যমে ভূমি উচ্চতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তৃতীয়ত. কয়েক দশক ধরে উপকূলীয় অঞ্চলে মোট ১২৩টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কয়েক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ। এসব বেড়িবাঁধ ভূমি অঞ্চলকে নদী ও জোয়ারভাটার প্লাবন থেকে আলাদা করে ফেলেছে। ফলে প্রাকৃতিক পলি স্তরায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় ক্রমে উপরে উঠে আসা সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় পোল্ডারের ভেতরে অবস্থিত এলাকা নিচু ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এসব বেড়িবাঁধ উপকূলীয় জনগণের মাঝে সাময়িক স্বস্তি নিয়ে এলেও সময়ের ব্যবধানে স্থায়ী জলাবদ্ধতাসহ আরো দুর্যোগ বয়ে আনবে। চতুর্থত. ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটাত ভূমিকর্ষণ ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূমিক্ষয় এবং অবদমনের কারণেও ভূমি উচ্চতা হ্রাস পাচ্ছে, যার জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় ভূমির গঠন ও উচ্চতা বাড়ছে না। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি অবদমন নিয়ে তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা যায় না; কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে একই ধরনের ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের ব-দ্বীপে চালিত গবেষণা থেকে জানা যায়, এসব অঞ্চলে ভূমি অবদমনের পরিমাণ অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি ব-দ্বীপের নিউ অরলিন্সে ভূমি অবদমনের পরিমাণ গত ১০০ বছরে প্রায় দেড় মিটার (৫ ফুট) বলে জানা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃদেশীয় প্যানেলের চতুর্থ রিপোর্ট অনুযায়ী, এ শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫৯ সেন্টিমিটার বাড়বে। অর্থাৎ বছরে শূন্য দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার বা ৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার। কোনো কোনো গবেষকের মতে, এর পরিমাণ ২ মিটারেরও অধিক হবে, যা বছরে গড়ে ২ সেন্টিমিটারের বেশি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ২০ শতাংশের বেশি জায়গার উচ্চতা ২ মিটারেরও কম। যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২ মিটার বেড়ে যায় আর সেই সঙ্গে ভূমি অবদমনের পরিমাণ যোগ করা হয়, তাহলে সমুদ্রতটরেখা বর্তমানের উপকূলীয় জেলাগুলো ছাড়িয়েও চাঁদপুর,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রবেশ করবে। অবশ্য এটি সত্য হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ একতরফাভাবে উপরে উঠে এলে এবং প্লাবন আর জোয়ারভাটার পলি স্তরায়ন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে, যেটা হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ শুকনো মৌসুমে উজানের দেশ থেকে একতরফাভাবে পানি সরিয়ে নিলেও বর্ষাকালের প্লাবন আর পলি স্তরায়ন থামিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বন্যার প্লাবন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিদিনের জোয়ারভাটা যতই বিপত্তিদায়ক মনে হোক না কেন, আসলে কোটি কোটি বছরের বন্যা আর জোয়ারভাটার প্লাবনেই বাংলাদেশ নামক ভূ-অঞ্চলের সৃষ্টি ও এ প্লাবন ও জোয়ারভাটাই একে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতি বছরে ২ সেন্টিমিটার (২০ মিমি) হারে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঠে আসলে বর্তমানের পলি স্তরায়নের মাধ্যমে এ হার মোকাবেলা করা সম্ভব হবে কিনা এবং কী কী উদ্যোগ নিলে পলি স্তরায়ন বাড়ানো সম্ভব? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসার বর্তমান হার ৪-৮ মিলিমিটার, যা কিনা প্রাক্কলিত হারের অর্ধেকেরও কম। উপরন্তু বর্তমান পলি স্তরায়নের হার অঞ্চলভেদে ৪-৫ মিলিমিটার, যা কিনা ২ সেন্টিমিটারের তুলনায় অনেক কম; এমনকি জাতিসংঘ প্যানেলের প্রাক্কলিত ৬ দশমিক ৭ মিলিমিটারের তুলনায়ও কম। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, পলি স্তরায়নের পরিমাণ বাড়ানো না গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসাকে বর্তমান হারে ভূমি গঠন দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তাই কী কী উপায়ে উপকূলীয় অঞ্চলসহ অন্যান্য প্লাবন ভূমিতে পলি স্তর বাড়ানো যায়, সেদিকেই নজর দিতে হবে।
এজন্য প্রয়োজনীয় পলিমাটির সরবরাহ জরুরি। ষাটের দশকে বাংলাদেশে প্রবাহিত অভিন্ন নদনদীবাহিত পলির পরিমাণ যেখানে ছিল প্রতি বছরে ২০০ কোটি টন, সেখানে বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটি টনে। পলি সরবরাহ কমে যাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে— গঙ্গা-যমুনা অববাহিকার উজানের অঞ্চলে বাঁধ ও ব্যারেজ তৈরির ফলে বাংলাদেশে আসা পানি এবং পলি সরবরাহ কমে যাওয়া। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারতে নির্মিত সব বাঁধেই বিপুল পরিমাণ পলি জমা হচ্ছে, যার একটা বড় অংশই কিনা বাংলাদেশে পানিপ্রবাহের সঙ্গে আসত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফারাক্কা বাঁধের উজানে প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি টন পলি জমা হয়, যা কিনা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। বর্তমানের ১০০ কোটি টন পলির মধ্যে প্রায় অর্ধেক সমুদ্রে চলে যায়, বাকি অংশ নদীর তলদেশে এবং প্লাবন ভূমিতে বন্যার সময় ছড়িয়ে পড়ে। শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া এবং বেড়িবাঁধের জন্য পলি উপকূলীয় ভূমিতে প্রবেশ করতে না পারায় নদীর তলদেশে জমা হয়ে নাব্যতা এবং উপকূলীয় নদীর পানি বহন ক্ষমতা কমিয়ে ফেলছে। এক হিসাবে দেখা যায়, সরবরাহকৃত পলির অর্ধেক বা ৫০ কোটি টন যদি সারা বাংলাদেশে সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়া যেত, তাহলে প্রতি বছর ভূমির উচ্চতা বাড়ত গড়ে ২ মিলিমিটার করে। অন্যদিকে একই পরিমাণ পলি শুধু উপকূলের নিম্নাঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া গেলে ভূমির উচ্চতা প্রতি বছর বাড়ত ৫ মিলিমিটার হারে; যা কিনা উপরে উঠে আসা সমুদ্রপৃষ্ঠকে মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় ৬ দশমিক ৭ থেকে ২০ মিলিমিটারের চেয়ে অনেক কম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানে প্রাপ্য পলি মাটি দিয়ে ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ বেড়ে ওঠা রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী? জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলায় সরকার ২০০৮ সালে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা পত্র’ তৈরি করেছে, যার আওতায় উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে সাতটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামত। তাছাড়া রয়েছে নদী শাসনের বিভিন্ন পরিকল্পনা। বেড়িবাঁধ নির্মাণ কীভাবে সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলবে তা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে নদী শাসনের মাধ্যমে পলি মাটি উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে ভূমির উচ্চতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে তা কিছু সুফল বয়ে আনবে। পলিস্তর বাড়ানোর বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের জলাবদ্ধতা ক্রমে বেড়ে যাবে এবং বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরে জনগোষ্ঠীর পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ও সুপেয় পানি সরবরাহকারী ব্যবস্থা আরো সমস্যায় পড়বে। বেড়িবাঁধগুলোকে বিভিন্ন স্থানে কেটে দিয়ে এগুলোর পেছনের ভূমিকে প্রাকৃতিক নিয়মে জোয়ারভাটায় প্লাবিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া জরুরি। জনগণের নেয়া এ রকম উদ্যোগ খুলনা-যশোরের কিছু অঞ্চলে বেড়িবাঁধের ভেতরকার অঞ্চলের ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে এবং নদীবক্ষে জমাকৃত পলি সরিয়ে নাব্যতা বাড়ানো গেছে বলে জানা যায়। বেড়িবাঁধগুলোর উচ্চতা বাড়িয়ে নিম্নাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বসবাসের জন্য ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া যায় কিনা, তাও বিবেচনা করা যেতে পারে। যে প্রাকৃতিক নিয়মে বাংলাদেশের ভূমি অঞ্চল কোটি কোটি বছরে গড়ে উঠেছে, সে প্রক্রিয়া বজায় রেখেই শুধু টিকে থাকা সম্ভব; প্রাকৃতিক নিয়মকে বাধাগ্রস্ত করে নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পানি-পলির সঠিক ব্যবহার ও এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদী-খাল-নালার তলদেশ থেকে মাটি কেটে বসতভিটার উচ্চতা বৃদ্ধির ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়া জরুরি। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য পলি মাটি ধরে রাখার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা জরুরি। উপকূলীয় অঞ্চলে অগভীর সমুদ্রে পলি আটকে রাখার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এবং সমুদ্রবক্ষ থেকে ড্রেজিং করে পলি এনে উপকূলীয় অঞ্চলের অগভীর অঞ্চলের ভূমি গঠন ও ভূমি উদ্ধার প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলেই এ রকম প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমি গঠন প্রক্রিয়া চলছে। হল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি উদ্ধার প্রকল্পের গবেষণা থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। তবে তা হতে হবে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ভূমিক্ষয়, পলিস্তর, পলিপ্রবাহ ও ভূমি অবদমনের পরিমাণ গবেষণার মাধ্যমে নির্ণয় করেই শুধু ভূমি গঠন ও উদ্ধারের বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া সমীচীন হবে। বাংলাদেশে ভূমি উচ্চতা বৃদ্ধিসহ ভূমি গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে আসার করাল গ্রাস থেকে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করা যাবে না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী যুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবেলা করার এখনই সময়।
বাংলাদেশ যেহেতু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের দেশ, তাই সঠিক সময়ে পরিমাণমতো পানি ও পলি সরবরাহের জন্য অববাহিকার উজানের দেশগুলোর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। অববাহিকাভিত্তিক সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে আসার ফলে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না। কারণ প্রয়োজনীয় পানি ও পলি সরবরাহ ব্যতিরেকে এ সমস্যা মোকাবেলার উপায় নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নদী, পানিসম্পদ ও পলির যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মধ্যেই নির্ভর করবে— ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ডুবে যাবে নাকি টিকে থাকবে।
লেখক: অধ্যাপক, ভূবিজ্ঞান বিভাগ, লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
mkhalequ@lhup.edu

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics