সুন্দরবন ও দক্ষিণ উপকূলে অবাধে মা-কাঁকড়া নিধন
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলতি প্রজনন মৌসুমে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) সুন্দরবন ও দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে মা-কাঁকড়া নিধন চলছে। বিপুলসংখ্যক জেলে এই কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁদের ব্যবহূত অবৈধ বেহুন্দি ও খুঁটিজালে ধরা পড়ছে বিপুলসংখ্যক মা-কাঁকড়া।
মৎস্যবিশেষজ্ঞরা জানান, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই দুই মাস সরকারিভাবে কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম চিহ্নিত করা হলেও এপ্রিল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে কাঁকড়া ধরার কারণে প্রজাতিটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
সরেজমিনে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা, কটকা, সূপতি, দুবলা, রায়েন্দা, বগি, খুড়িয়াখালী; বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা, পাথরঘাটার সংরক্ষিত বন হরিণঘাটা, লালদিয়া ও বলেশ্বর নদের তীরের পদ্মা, হাজিরখাল, চরদুয়ানি, ছোট টেংরা, লাঠিমারা; পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও কুয়াকাটা এলাকায় প্রতিদিন কয়েক হাজার জেলে কাঁকড়া ধরার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁরা চাই ও বরহা দিয়ে এসব ডিমওয়ালা কাঁকড়া ধরছেন। এ ছাড়া তাঁদের ব্যবহূত অবৈধ খুঁটি ও বেহুন্দি জালে প্রতিদিন অসংখ্য ডিমওয়ালা কাঁকড়া আটকা পড়ছে। বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলের কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করে জেলেদের দিয়ে নির্বিচারে ডিমওয়ালা কাঁকড়া নিধন করাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা এলাকার এক জেলে জানান, তাঁরা এক সপ্তাহের পাস নিয়ে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নৌকা নিয়ে কাঁকড়া ধরতে যান। এক সপ্তাহে তাঁরা দুই মণ ধরেন। সুন্দরবন এলাকায় কমপক্ষে দেড় হাজার জেলে এ কাজে নিয়োজিত বলে জানান তিনি।
২১ ফেব্রুয়ারি পাথরঘাটার বলেশ্বর নদের তীরের রুহিতা শুঁটকিপল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে, বেহুন্দি জালে অন্যান্য মাছের সঙ্গে অসংখ্য মা-কাঁকড়া ধরা পড়েছে। কয়েকটি শিশুশ্রমিক এগুলো বাছাই করছে।
স্থানীয় জেলেরা জানান, স্রোতের চাপে হাত-পা ভাঙা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় এসব কাঁকড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিদরে বিক্রি করেন তাঁরা। জীবিত মা-কাঁকড়া একেকটি ৯০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। রুহিতা এলাকায় ২০০ জন জেলে বেহুন্দি জালে মাছ ধরেন। এসব জালে প্রতিদিন অসংখ্য মা-কাঁকড়া ধরা পড়ে।
তালতলীর টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনের কাঁকড়াশিকারি অমল চন্দ্র জানান, তাঁরা প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত কেজি করে কাঁকড়া ধরেন। দুই থেকে তিনটি কাঁকড়ায় এক কেজি হয় এবং প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে বিক্রি করেন। এখানে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ জন জেলে প্রতিদিন কাঁকড়া শিকার করেন বলে জানান তিনি।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার আড়তদার সেলু মিয়া জানান, এখন কাঁকড়ার মৌসুম নয়। তবুও রামপাল, চাঁদপাই, চরদুয়ানি, মংলা, বাগেরহাট, শরণখোলা মোরেলগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার কমপক্ষে দেড় হাজার জেলে পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় এ কাজে নিয়োজিত।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ জানান, প্রজনন ও প্রজনন-পরবর্তী সময়ে কাঁকড়া শিকার বন্ধ ও এর অভয়াশ্রম চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর প্রজনন ও উৎপাদন অনেকটা হুমকির মুখে। তার ওপর প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মা-কাঁকড়া নিধন করা হলে শিগগিরই প্রজাতিটির বিলুপ্তি ঘটবে।
প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া ধরার কথা অস্বীকার করে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক কাস্যাতি বিকাশ চন্দ্র জানান, এবার প্রজনন মৌসুমে পূর্ব সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, লোকবল-সংকটের কারণে তাঁরা এ ব্যাপারে নজরদারি করতে পারছেন না। অবৈধ জালের ব্যবহার ও কাঁকড়া নিধন বন্ধে তাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-02/