সুনামগঞ্জে নাব্যতা হারিয়েছে ১৩৬ কিলোমিটার নদীপথ

মত্স্য, পাথর, ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ। এই কথাটি গোটা সুনামগঞ্জ জেলার হলেও এর আসল বাস্তবতা হলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মশালার বেলায়। এই এলাকায় মত্স্য, পাথর, ধানই শুধু নয়, এখানে রয়েছে বড় বড় জলমহাল, চুনাপাথর ও কয়লার শুল্ক স্টেশন। এসব জলমহাল, বালি-পাথর কোয়ারী ও শুল্ক স্টেশনকে ঘিরে রয়েছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। কিন্তু কোটি কোটি টাকার পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ, যেখান থেকে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থেকে।
jadukata nodi sunamganj-10
নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক সময় যে খরস্রোতা নদীগুলো ছিল এখন সেগুলো আর দেখা যায় না। পলিমাটি ও বালি পড়ে অনেক নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে নদীপথের নাব্যতা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। কতিপয় প্রভাবশালী ভূমিখেকো ও নদী দখলবাজের কারণে নদীপথে নাব্যতা সঙ্কট সৃষ্টি হয়ে আসছে। এক সময় সুনামগঞ্জ জেলার খরস্রোতা নদীগুলোতে কার্গো জাহাজ চলাচল করলেও এখন কার্গো জাহাজতো দূরের কথা, ডিঙ্গি নৌকা চলাচল আর কলসি ডুবানো দায়। সুনামগঞ্জে ১২০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে উত্পত্তি হয়ে জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত সীমান্ত নদী জাদুকাটা, রক্তি, বৌলাই ও পাটলাই এই চার নদীতে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে পানির সাথে নেমে আসা বালিমাটি ও পলি জমে নদীর উত্সমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং গত পৌষ মাসের প্রথম থেকেই নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে সুনামগঞ্জ জেলার ১৩৬ কিলোমিটার নৌপথজুড়ে দেখা দিয়েছে চরম নাব্যতা সংকট।

বৈশাখ মাসে নদীগুলো দিয়ে নেমে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢল ও অকাল বন্যার পানিতে এ জেলার লাখ লাখ মানুষের একমাত্র ভরসা হাজার হাজার একর বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যায় । কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে দেখা দেয় চরম পানি সংকট। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর তাহিরপুরে এক কৃষক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীগুলো দ্রুত ড্রেজিংয়ের আশ্বাস দিলেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ জাদুকাঁটা নদীর বুকে বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার বারকি শ্রমিক বালি-পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠায় দেখা দিয়েছে নাব্যতা সংকট। বালি-পাথর উত্তোলন করতে পারছে না শ্রমিকরা। ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রক্তি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জাদুকাঁটা ও সুরমা নদীর সঙ্গে নৌ যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। এতে করে এখানকার বালি-পাথর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজারের অধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কষ্টে দিন কাটাচ্ছে নদীতে কাজ করা হাজারের অধিক পরিবার। তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলাকে সংযোগকারী ৫৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বৌলাই নদীতে পলি জমে তলদেশ উঁচু হয়ে নদীর বুক পানিশূন্য হয়ে পড়ায় ফুটবল খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। টেকেরঘাট বড়চড়া শুল্ক স্টেশন থেকে কয়লা পরিবহনের জন্য ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাটলাই নদীর উত্সমুখে পানি না থাকায় কয়লা পরিবহনে দেখা দিয়েছে সমস্যা।

তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের মো. কুদ্দুছ মিয়া জানান, বড়ছড়া শুল্ক স্টেশনকে ঘিরে চার শতাধিক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পাটলাই নদী দিয়ে যেখানে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও কার্গোতে করে প্রতিদিন হাজার হাজার টন কয়লা ও চুনাপাথর সারাদেশে সরবরাহ করে থাকে সেই নদীর উত্সমুখই পানিশূন্য। যেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রতি টন কয়লা ক্যারি করতে খরচ তো ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে পানি আটকানোর জন্য বাঁধ দেয়ার পর অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত ডিপো থেকে চার ধাপে টেলাগাড়ি, লরি, হ্যান্ডট্রলি ও বারকি নৌকা দিয়ে পাটলাই নদীতে থাকা ট্রলার ও কার্গোতে প্রতি টন কয়লা ও চুনাপাথর লোড করতে খরচ হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। এ অবস্থায় নদী খনন করা না হলে ব্যবসায়ীদের বিড়ম্বনা আরও বাড়বে। পাটলাই নদীতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক জীবিকা চালাত। এখন নদীর উত্সমুখে পানি না থাকায় এবং নদীতে নৌকা চলাচল করতে না পারায় গত এক মাস ধরে বেকার বসে আছে তারা।

জামালগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪১ বছরেও এই নদীগুলোর সংস্কার ও খনন না করায় নাব্যতা সংকটের মুখে পড়েছে। তিনি জানান, ভাটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই উপজেলাগুলোর সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এখনো সেই অতিতের মতোই হেমন্তে পাও (পা) আর বর্ষায় নাও (নৌকা) এ এলাকার লাখ লাখ মানুষের ভরসা। জাদুকাঁটা, বৌলাই, রক্তি ও পাটলাই এখানকার বড় নদী। তাহিরপুর উপজেলায় ছোট-বড় ২০টির অধিক হাট-বাজার রয়েছে। হাট-বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে। হাওর থেকে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ার ফলে হাওরের পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। ফলে অতীতের তুলনায় এখন হাজার হাজার একর বোরো জমি অনাবাদি থাকে। সুনামগঞ্জ, ভৈরব ও মোহনগঞ্জ থেকে উপজেলা সদর তাহিরপুর, বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাদাঘাটে মালামাল আনতে নদীর নাব্যতার কারণে ৫০০ কিলোমিটার নৌপথে ব্যবসায়ীদের দ্বিগুণ খরচ ও অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামালের দামও কিছুটা বেড়ে যায়।

মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা জাদুকাঁটা নদী বালিজুরীর কাছে রক্তি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর একটি শাখা মিলিত হয়েছে বৌলাই নদীর সঙ্গেও। দেশের সিংহভাগ বালি-পাথরের চাহিদা পূরণ হয় জাদুকাঁটা নদী থেকেই এবং সরবরাহ হয়ে থাকে এ নদী থেকেই। তাই মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও পাথরের জন্য নদীটি সম্পদশালী ও গুরত্বপূর্ণ। নদীর তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দারা ও বাদাঘাট ইউপি সদস্য নিজাম উদ্দিনসহ অনেকেই জানান, এই নদীর উপর ৩০ হাজার শ্রমিক ও ২০ হাজার ব্যবসায়ী পরিবারের জীবিকা নির্ভর করে। কিন্তু কয়েকমাস নদীতে পানি না থাকায় শীতের শুরুতেই বড় নৌকার পরির্বতে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে বালি-পাথর বড় নৌকায় নিয়ে লোড করতে হয়।

http://ittefaq.com.bd/

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics