বিষমুক্ত কলায় রঙিন জীবন

জীবিকার তাগিদে কী না করেছেন তিনি! গ্রামের পথে-ঘাটে ঘুরে গোবর ও খড়কুটো কুড়িয়েছেন। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পেঁয়াজ-রসুন বাকিতে কিনে বাজারে বিক্রি করেছেন। ট্রেনে ও বাসে ফেরি করে কলা বেচেছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার আশায় সহায়-সম্বলহীন, স্বপ্নবান এক তরুণ দেশব্যাপী এখন সফল কৃষক হিসেবে পরিচিত। জৈব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, অল্প খরচে বিষমুক্ত কলা চাষের কৌশল বের করেছেন তিনি। জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। কলা চাষে বিপ্লব এনে সবার কাছে তিনি এখন ‘কলা কাদের’ নামে পরিচিত।

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ঢোলজানী গ্রামে কলাবাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত আবদুল কাদের।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ঢোলজানী গ্রামে কলাবাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত আবদুল কাদের।

অভাবের দিনগুলো: আসল নাম তাঁর আবদুল কাদের (৪৩) চার ভাই, সাত বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। জন্ম চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। বাবা শহীদুল ইসলাম কৃষিকাজের পাশাপাশি ধানের ব্যবসা করতেন। ধান সেদ্ধ করতে গোবর ও খড় জোগাড় করে আনতে হতো কাদেরকে। বাবা চাইতেন, ছেলে তাঁর সঙ্গে কাজ করুক। কিন্তু কাদেরের ভেতরে ছিল নতুন কিছু করার ইচ্ছা। ইতিমধ্যে বিয়ে করেন তিনি। সে ১৯৯১ সালের কথা। অভাব-অনটনের কারণে যৌথ পরিবার থেকে তাঁকে আলাদা করে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে নিয়ে কাদের চলে আসেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ঢোলজানী গ্রামে।
স্বপ্নের বুনন: প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচ কিনে বাজারে বেচা শুরু করলেন কাদের। এতে গৃহস্থের টাকা পরিশোধের পরও অল্প অল্প পুঁজি জমতে থাকে। এক বছরের জমানো দেড় হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন ঝিনাইদহ শহরে। এক আত্মীয়ের সঙ্গে শুরু করেন ফেরি করে কলা বেচার ব্যবসা। ট্রেনে, বাসে ও শহরের জনবহুল স্থানে কলা বিক্রি করে লাভ হওয়ায় প্রতিদিনই টাকা জমতে থাকে।
এক বছর পর যৌথ ব্যবসা চুকিয়ে এককভাবে ব্যবসা শুরু করেন। এ সময় তিনি দেখতে পান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে খাদ্যের তালিকায় কলা রাখা হয়। একদিন চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, কলার খাদ্যমান বা পুষ্টিগুণ অন্যান্য যেকোনো ফলের তুলনায় বেশি। এটি জানার পর তাঁর মাথায় ঢোকে কম দামে মানুষকে কলা খাওয়ানোর ভাবনা। শুরু করেন কলা চাষ।
কলা আবাদ: ঢোলজানী গ্রামে এসে প্রতিবেশী অবস্থাপন্ন কৃষক তোরাব আলীকে কলা চাষে উৎসাহী করে তোলেন। তোরাব আলীর দুই একর ১০ শতাংশ জমিতে ২০০৮ সালে শুরু করেন রঙিন সাগর কলার চাষ। দুই হাজার ১০০ কলার চারা লাগিয়ে প্রথম বছরেই ভালো ফলন পান। এতে উৎসাহ আরও বেড়ে যায় তাঁর। এলাকার ৫৪ জন কৃষক নিয়ে সমিতির মাধ্যমে কলার আবাদ শুরু করেন। সাথি ফসল হিসেবে কলাবাগানে রোপণ করেন বিভিন্ন শস্য। শুধু ঢোলজানী গ্রাম নয়, আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে কলার চাষ শুরু হয়। যাঁদের জায়গা নেই, তাঁরাও বাড়ির উঠান বা পরিত্যক্ত জমিতে কলাগাছ লাগান। এতে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাড়তি কিছু লাভ হওয়ায় সবাই খুশি।
জৈব সার প্রয়োগ ও পুরস্কার: গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ও ছাই দিয়ে তৈরি জৈব সার ব্যবহার করেন কাদের। ২০১২ সালে কৃষি বিভাগ দেশসেরা ১২ জন কৃষকের নাম ঘোষণা করে। এর মধ্যে আবদুল কাদেরের নামও ছিল। ২০১০ সালে ঢাকায় জাতীয় ফলদ বৃক্ষ মেলায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় এবং ২০১১ সালে তৃতীয় স্থান অধিকার করে জাতীয় পদক জিতে নেন। এখন তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষিবিষয়ক কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নিয়ে জৈব প্রযুক্তির বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছেন কলা কাদের নামে।
দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা আবদুল কাদের জানান, জৈব প্রযুক্তিতে কলা চাষের পদ্ধতি তিনি সারা দেশে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান।
রাজবাড়ী উদ্যানবিদ্যা কেন্দ্রের (হর্টিকালচার সেন্টার) সহকারী উদ্যানতত্ত্ববিদ আশুতোষ কুমার বিশ্বাস জানান, কলা কাদেরের জৈব সার যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি পুষ্টিগুণসম্পন্ন। এই সার ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে, আবার ফলন বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ। সারা দেশে এই চাষপ্রক্রিয়া ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশের খাদ্যমান বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৯,০৩,২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics