কেমন আছেন চা- শ্রমিকরা ?
ফারজানা হালিম নির্জন
এক কাপ চা’য়ে আমি তোমাকে চাই… “তোমাকে” বলতে এখানে যে যার ইচ্ছেমত অনুভূতি বসিয়ে নিতে পারেন। হতে পারে প্রিয় কোনো মানুষ,অথবা প্রিয় গল্পের বইটা,অথবা ধরুন না, নিজের মনের তরতাজা ভাবটাকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। এক কাপ চা ছাড়া যেন সবকিছুই অর্থহীন। ভেবে দেখুন,সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আপনাকে চাঙ্গা রাখতে চা কিন্তু আপনার সর্বক্ষনের সঙ্গী হয়েই পাশে আছে। সকালের পত্রিকায়,ব্যস্ততার অবসরে,বন্ধুদের আড্ডায় একটা জিনিস চাই ই চাই। এক কাপ ধুমায়িত গরম গরম চা। কিন্তু আপনার হাতে ঠিক সময়মত এক কাপ চা তুলে দিতে যারা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন,সেই চা শ্রমিকরা কেমন আছেন ?
সময়ের আবর্তনে বদলায় অনেক কিছু,কিন্তু বদলায়না চা-শ্রমিকদের জীবনমান। চা-গাছের সাথে বন্দী তাদের জীবিকা,তাদের ভাগ্য। কিন্তু ভাগ্যের দেবী মুখ তুলে তাকান না কখনোই। কৃতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও,যেন বিলুপ্ত হয়নি এখনো কোথাও কোথাও। এই গোষ্ঠীটি এখনো অদৃশ্য কোনো শোষনের কালো হাতের কাছে দাসত্ব গ্রহণ করেই কাটাচ্ছে এক একটি ভয়ংকর দিন,এক একটি বিভীষিকাময় রাত। পাহাড়ি জঞ্জাল কেটে পরিষ্কার করা,বাগানের চা পাতা তোলা,রাস্তা কাঁটা,বাড়ি-ঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে ফ্যাক্টরীর ভেতরে নানান কাজে সংশ্লিষ্ট থাকেন প্রায় লাখ লাখ চা-শ্রমিক। কিন্তু, তাদের দৈনিক পারিশ্রমিকের পরিমাণটা শুনলে হয়তো মনে মনে আরো একবার ভেবে নিবেন,ভুল দেখলাম না তো! প্রতিদিন আটঘন্টার বেশি সময় কাজ করেও তাঁরা পান ৫৫ টাকা! বাগানের পাতা তোলার কাজে যারা নিয়োজিত,তাঁরা প্রতি কেজি তোলার জন্য পান ২ টাকা। দৈনিক সর্বোচ্চ ২০- ২৫ কেজি পর্যন্ত পাতা তোলা সম্ভব হয় এক একজন শ্রমিকের পক্ষে। কিন্তু বেতনটা যে শুধুই ২৩ কেজি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কেউ এর বেশি তুললে বেশি টাকা পান না,কিন্তু কম তুললে ঠিকই টাকা কেটে রাখা হয়। হিসেব নিকেশটা শুধু যেন তাদের জন্যই তৈরী করা। বর্তমান বাজারের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গেলে তাঁরা এই টাকায় ১ কেজি চাল আর ১০০ গ্রাম ডাল্ ছাড়া কিছুই কিনতে পারেন না। কোনো কোনো বাগানের শ্রমিকরা সপ্তাহে ৩ কেজি রেশনের চাল আর আটা পান। তবে সেখানেও থাকে অবহেলা আর ফাঁকিঝুঁকির গল্প। এই নিয়েই পরিবার-পরিজনদের নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে এখনো লড়াই করে যাচ্ছেন আমাদের চা শিল্পের কারিগররা। কষ্টের কথা এক নাগাড়ে শুনতে আমাদের ভাল লাগেনা। এর মাঝে সামান্য বিরতি না হলে যেন তা সহ্যশক্তির সীমা অতিক্রম করে ফেলে। তাই চা শিল্পের কথা যখন চলেই এলো,এই শিল্পটি নিয়ে একটু বলা যায়।
উপমহাদেশ থেকে বৃটিশরা বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে চলে গেলেন ঠিকই,কিন্তু রেখে গেলেন এমন এক জিনিস,যা বাঙ্গালী জাতির মধ্যে আরো শিঁকড় ছড়িয়ে গেঁথে বসেছে। চায়ের অভ্যাসটা বৃটিশদের কাছ থেকেইতো শেখা। সর্বপ্রথম ১৮৪০ সালে এ দেশে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হওয়ার পর,এক পর্যায়ে এ খাতটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য অন্যতম প্রধান শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু ক্রমেই উৎপাদনের তুলনায় এর অভ্যন্তরীন চাহিদা প্রায় ১০ গুণ বেড়ে যাওয়ায়,এখন বাংলাদেশ চা আমদানীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর ব্যাপক প্রসার ও গুরুত্ব পেয়েছে এই চা শিল্প। অথচ গুরুত্ব পায়নি চা-শিল্পের পেছনের যোদ্ধাদের জীবনযাত্রার করুণ চিত্র।
ঘুরে ফিরে আবারো সেই একই কথা। রোদে পুড়ে গা’য়ের চামড়া তামাটে বর্ণের হয়ে যাওয়া সেই চা-শ্রমিকদের তামাটে কষ্টের কথা। মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু মৌলিক চাহিদা থাকে। কিন্তু চা-শ্রমিকদের অবশ্য প্রাপ্য সেই মৌলিক চাহিদাগুলো থেকেও যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভাগ্যদেবী। ভাঙ্গা জরাজীর্ণ ঘরে,বসবাস অনুপযোগী ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে মাথা গুঁজতে হয় তাদের। নেই ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করে মানুষ করবার স্বপ্ন দেখার সুযোগ,নেই চিকিৎসা সেবা। যেকোনো রোগের ঔষধের প্রেস্ক্রিপশন যেখানে প্যারাসিটেমল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়,সেখানে তাদের বেঁচে থাকাটাই একটি বড় আশীর্বাদ হয়তো! নেই সুপেয় পানির সুব্যাবস্থা। এ তো কেবল মৌলিক চাহিদাগুলোর কথা,বাকি রয়ে গেলো আরো অনেক ছোটো ছোটো গল্প। নিজেদের গড়ে তোলা চা এর সাথে দুধ-চিনি মিশিয়ে খাওয়ার ভাগ্যটুকুও হয়নি তাদের অনেকের। সকালবেলা লবণ দিয়ে এক মগ চা আর দু’মুঠো চাল ভাজা খেয়ে প্রস্তুতি নিতে হয় সারাদিনের সংগ্রামের জন্য। আর বাগানে যখন কাজ করেন,রোদ-বৃষ্টি সব মাথায় নিয়ে ঠায় দু’পায়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেন পুরো দিনটা। সাঁপ,বিচ্ছা,জোঁক তাদের জীবনের জন্য এক স্বাভাবিক ব্যাপার। আর যারা কীটনাশক ছিটানোর দায়িত্ব পালন করেন,তাদের প্রয়োজনীয় মুখোশ,গ্লাভস,চশমা কিছুই সাথে থাকেনা। অনেকে বিষাক্ত কীটনাশক ছিটানোর সময় অন্ধ হয়ে যান। এমনি আরো অনেক দুঃখ-দুর্দশার কথা বাকিই থাক নাহয়। অনুনয়,বিনয় আর আকুতিতেও যখন কাজ হয়না,তখন তাঁরা সংগ্রাম করেন। বিদ্রোহ করেন হঠাৎ হঠাৎ,কিন্তু বেলা শেষে প্রাপ্তির ঝোলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। হতাশা আর ভাগ্যের নিয়তিতে জীবন সঁপে দিয়ে আবারো ফিরে যান তাদের পুরোনো স্বাভাবিক জীবনে।
প্রতিদিনের একইরকম অমানবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে মুখ বুজে কাজ করে যান তাঁরা,কিন্তু পারিশ্রমিক সহ তাদের মৌলিক চাহিদার প্রায় সবকটি দরজাই যেখানে বন্ধ ,সেখানে কতটুকুই বা প্রাপ্তি তাদের! হয়তো প্রাপ্তির স্বাদ বলতে কী বুঝায়,তা তাঁরা জানেন না। অথবা কেউ কেউ জেনেও না জানার ভান করে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন এই পেশায়,একমাত্র পূর্বপুরুষদের সম্মান রক্ষার্থে। অথবা কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন,স্বাভাবিকভাবেই জীবিকার পথ হিসেবে এই পেশা বেছে নিতে। যেই ঘরটিতে তাঁরা বসবাস করেন,সেই ঘরটিও কখনো তাদের নিজের হয় না। কারণ ঘরটি ধরে রাখতে চাইলে,পরিবারের অন্তত একজনকে চা-শ্রমিক হতেই হবে!
চা-বাগান ঘুরে দেখতে তো অনেক মানুষই আসেন,কিন্তু ক’জন দেখতে যান সেই মানবেতর জীবন-যাপনের শীকার হওয়া তামাটে বর্ণের অসহায় মানুষগুলোকে? শিক্ষার আলোর প্রদীপ তাদের ঘরে জ্বলেনা কখনো,তাদের ঘরের শিশুদের কোমল হৃদয়ের লালিত স্বপ্ন হয়তো,বাবা-মা’য়ের মতো একদিন সেও চা-শ্রমিক হয়ে বাগানে কাজ করবে! সেই অসহায় বাবা-মা’য়েদের করুণ মুখ কেউ কি কখনো দেখতে যায় ? পরিবেশ আর দেশের এতোটুকু অংশও কি তাঁরা নন ? সত্যিই তো,আমরা কেউ কি কখনো মন থেকে ভাবি,কেমন আছেন তাঁরা ?