ও নদী রে…বাংলার নদী; অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ
আল মারুফ রাসেল
মরে যাচ্ছে বাংলাদেশের নদীগুলো। ফলে হুমকির মুখে প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি ও তীরবর্তী জনপদের অকৃত্রিম জীবনধারা।
নদী আর মানুষের জীবন একই সূত্রে গাঁথা। প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুরু করে উত্তরাধুনিক সাহিত্য- সব জায়গাতেই নদী তার স্বীয় অবস্হান ধরে রেখেছে। কারণ, নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ আর বিস্তৃতি। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যায়ও এসেছে নদী। নির্বাণের রূপক। কখনো তা ভাসিয়ে দিয়েছে মানব বসতি। কখনো মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে নদীকে বশ করতে চেয়েছে। আর তা করতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছে বহু নদীর।
বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা কতো, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে চলনসই জবাব রয়েছে সরকারি হিসাবে, ২৫০টি। শাখা-প্রশাখা আর উপনদী ধরে এই সংখ্যা চার অঙ্কের ঘরে। বাংলাদেশের এই নদীগুলো চীন, ভারত, নেপাল আর ভুটানের ১ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার অববাহিকার প্রায় ছয় মিলিয়ন কিউসেক পানি বঙ্গোপসাগরে নিয়ে ফেলে। আর প্রতিবছর প্রায় আড়াই বিলিয়ন টন পলি বহন করে এই নদীগুলো।
আমাদের দেশের অতীত-বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। অখণ্ড বাংলার বিভিন্ন প্রদেশের সীমারেখা নির্ণয়ে কাজে এসেছে নদী। ৬৩০ সালে যখন হিউয়েন সাং বাংলায় আসেন, তখন করতোয়া ছিল বিশাল এক নদী, যা পুন্ড্রবর্ধনকে (উত্তরবঙ্গ) আলাদা করেছিল কামরূপ (আসাম) থেকে। পরবর্তীকালে এই প্রবাহ মরে গেলে যমুনা হয়ে উঠেছিল উত্তরবঙ্গ আর আসামের সীমানা। প্রাচীনকাল থেকেই নদী এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি জল নিঃসরণ করে, জমির উর্বরতা বাড়ায়, আবার মাছের জোগান দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। সবচেয়ে সস্তা ও সহজ যোগাযোগের মাধ্যমও বটে। রেনেল ১৭৮১ সালে বলেছিলেন, বাংলার নদ-নদী কমপক্ষে ৩০ হাজার মাঝির অন্ন জোগায়।
নদীর প্রবাহ বা খাত পরিবর্তন যেকোনো জনপদের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এমনটি ঘটে এবং এর ফলে একটি জনপদ খুব দ্রুত স্হবির হয়ে পড়ে। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ভৈরব, কপোতাক্ষ ও যমুনার খাত মজে যেতে থাকলে যশোর-খুলনা এলাকায় মানুষ কমে যেতে থাকে। আবার চিত্রা নদী তখনো সজীব থাকায় নড়াইলের জনসংখ্যা সে সময় বেড়ে গিয়েছিল। তবে ইদানীং আমাদের নদীগুলোর খাত মূলত মানুষের কারণেই বদলে যাচ্ছে। বাঁধ ও সেতু নির্মাণ বা অন্য কোনো কারণে নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হলে নদীর খাত শুকিয়ে যায়। শস্য-শ্যামলা মাঠ হয়ে ওঠে অনুর্বর আর শুষ্ক। যেমন বাগেরহাটে খাল কাটার পর ভৈরব নদের অপমৃত্যু হয়। এই পথে রয়েছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা আরও ৯৫টি নদী। ৪২টি নদী এখন কেবল মৌসুমি নদী হিসেবে পরিচিত। আর উপনদী-শাখা নদীর মৃত্যুর খতিয়ান নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এই হার অব্যাহত থাকলে মৃত্যুপথযাত্রী আর মৌসুমি নদীগুলোও কিছুদিনের মধ্যেই বিলুপ্তির তালিকায় স্হান পাবে।
দেশের প্রধান চারটি নদী- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র পলি জমে ভরাট হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে ঘোলা পানির চেয়ে সাদা বালির চাকচিক্যই বেশি চোখে পড়ে! শুধু বাংলাদেশেই সহস্রাধিক নদীর সমন্বয়ে গঠিত বিশাল এক নদীব্যবস্হা রয়েছে। আর কোনো দেশে তা অকল্পনীয়। সরকার বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একের পর এক নদী হারিয়ে যাচ্ছে। মূলত অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে এ দেশের অনেক নদী হারিয়ে গেছে। ফলে বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রাও। ১৯৭৫ সালে এ দেশে নৌপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার, এখন তা মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। শুকনো মৌসুমে এই পথ আরও কমে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারে এসে থামে। দূষণ আর ভরাটের কারণে বদলে যাচ্ছে নদীর চেহারা। অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত নদীশাসনের ফলে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে নদী, হারাচ্ছে নাব্যতা। অপরিকল্পিত ড্রেজিং বা একেবারেই ড্রেজিং না করা, আর ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণের কারণে নদী মৃত্যুর মুখে পড়ছে। কপোতাক্ষ, ইছামতী, ভৈরব, মুক্তেশ্বরী, বেতনা, নরসুন্দা, ফুলেশ্বরী, ধনু, রূপসা, ডাকি, শিবসাসহ আরও কতো নদ-নদী পরিণত হয়েছে সরু খালে! এমনকি অপরিকল্পিত রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণের কারণেও নদী ভরাট হয়। মূলত দীর্ঘ সময় অবহেলা করার কারণেই এ দেশে নদীমৃত্যুর হার বাড়ছে। কোনো-কোনোটির আস্হা এত খারাপ যে, চেষ্টা করেও নাব্যতা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য, প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। কিন্তু এখনো সাফল্য প্রায় শূন্যের ঘরে। অথচ নাব্যতার অভাবে কেবল গত দুই বছরে ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশি নৌপথ আর ১২টি ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবছর অন্তত দেড় থেকে দুই কোটি ঘনমিটার পলি অপসারণ করা প্রয়োজন একটি মৃতপ্রায় নদীকে সচল রাখতে। আর যেগুলোতে এখনো প্রাণের স্পন্দন রয়েছে, সেখানে প্রতিবছর ৫০ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের কারিগরি দক্ষতা এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রতিবছর মাত্র ৩০ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করা সম্ভব।
এ ছাড়া রয়েছে অভিন্ন নদীর নীতিমালা। বাংলাদেশ আর ভারত ৫৫টি নদী ভাগাভাগি করে আছে। ভাটির দেশ হওয়ায় পানির জন্য উজানের দেশ ভারতের কৃপার ওপরেই অনেকটা নির্ভর করতে হয় বাংলাদেশকে। ভারত বিভিন্ন বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহে বাধা দিচ্ছে বেশ আগে থেকেই। ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা বাঁধ এখন টিপাইমুখ আর সারি নদীর বাঁধ। অভিন্ন নদীর নীতিমালার তোয়াক্কা ভারত করে না। এখন ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে হয়, পারিপার্শ্বিক প্রভাব বিবেচনা করতে হয়, ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নিতে হয় উজানের দেশকে। ভাটির দেশ রাজি না থাকলে এমন প্রকল্প গ্রহণের অধিকার উজানের দেশের থাকে না। এমনকি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার পানি বণ্টন চুক্তি, জাতিসংঘের বায়োডাইভারসিটি কনভেনশন, কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস ১৯৯৭ নীতিমালাও বিবেচনায় আনে না ভারত। এসব আইনে সবার আগে প্রত্যেক মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে, এমনকি প্রাণবৈচিত্র্যের কথাও এসেছে।