লাউয়াছড়া-অভিজ্ঞতা
২০১০, ১৪ এপ্রিল রাতে শ্রীমঙ্গল শহরে যখন পৌঁছাই তখন ঘড়ির কাটা দশটা ছুঁয়েছে মাত্র। নাহার পেট্রোল পাম্পের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে সি.এন.আর.এস/ইউপ্যাক এর রেস্ট হাউজ খুজেঁ পেতে আরো মিনিট দশেক। সেখানে পরিচয় হল জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের রথীন্দ্র-দা আর শিবলী-ভাইয়ের সাথে। লাউয়াছড়া এক্সপিডিশানে আমরা তিনজনে এসেছি ইংল্যান্ডে কনসারভেশান বায়োলজিতে পাঠরত সামিয়া সেলিমের গবেষণাকার্যে সাহায্য করতে । গবেষণার বিষয় ‘Effects of Tourism on Wildlife’ । রুম বুঝে নিয়ে সেদিনকার মতো হাতে বিকরাম গারেওয়াল, ড. মনিরুল খানের ফিল্ডগাইড আর কানে অর্ণব-টিম ম্যাকগ্রকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । সকালবেলা ঘুম ভাঙে সামিয়া আপুর ফোন পেয়ে । ভোর রাতেই ঢাকা থেকে চলে এসেছেন তিনি । দ্রুত ব্যাগপ্যাক রেডি করে সাথে থাকা টয়োটা গাড়িটায় চেপে বসলাম আমরা চারজন । পথে আমাদের সাথে যোগ দিলেন বন বিভাগের নিসর্গ প্রজেক্টের গাইড বেনেডিক্ট-দা । চাপাচাপি করেই শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের পথে এগোতে থাকলাম আমরা । আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মূলত: আগের রাতের বৃষ্টি। পথের দুদিকেই বিস্তৃত চা বাগান। বৃষ্টি হওয়ায় চারপাশের শ্যামলীমা নবরূপে দৃষ্টিগত হচ্ছিল। বাগানের মাঝে কৃষ্ণচূড়ার লাল আর জারুলের বেগুনী দেখতে বেশ লাগছিল – সোনালু/রাঁধাচূড়ার হলুদ তাতে যোগ হলে মন্দ হত না মোটেও। কাক ডাকা ভোরেই বনের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর কর্মচাঞ্চল্য আরম্ভ হয়ে যায়। সাইকেলে, টেম্পোতে কিংবা পায়ে হেঁটেই কেউ আনারস, কেউ কলা, কেউবা শুঁটকী নিয়ে শহরের পথে রওনা হয় । শহরের ব্যস্ততার চেয়ে এই ব্যস্ততা অনেক বেশি প্রাকৃতিক – অনেক বেশি অযাণ্ত্রিক। ফরেস্টে আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে কতক আলোচনা করতে করতেই আমরা পৌছেঁ গেলাম লাউয়াছড়ায় । গাড়ি থামানোর আগেই এক জোড়া বন মোরগ (Red Jungle Foul) গাড়ির সামনেই রাস্তা পার হয়ে আমাদের চাঙ্গা করে দিল । তবে এতো কাছ থেকে স্ন্যাপ মিস করায় আফসোস হতে লাগলো । তার চেয়ে বেশি আফসোস হল যখন মনে পড়ল আমার ক্যামেরার অবস্থার কথা । কিছুদিন হল লেন্সের একটি সমস্যার জন্য দূরের/পাখির ছবি তোলা সম্ভব হচ্ছিল না । তাই মানসিক প্রস্তুতি ছিল শুধু পাখি স্পটিং-এ মনোযোগ দেয়ার । মূল প্রবেশপথের সামনে গাড়ি থামিয়ে আমরা ইকুইপমেন্ট বুঝে নিতে থাকলাম । আমার হাতে থাকল ক্যামেরা, নাইকনের দূরবীণ আর একখানা জি.পি.এস । ভেতরে ঢুকে আমাদের কাজের ফাইনাল ব্রিফিং করে দিলেন সামিয়া আপু । ১,২৫০ হেক্টরের লাউয়াছড়া মূলত ২,৭৪০ হেক্টরের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের অংশ বিশেষ । এতে পর্যটকদের সুবিধার্থে আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা আর তিন ঘন্টা হিসেবে পায়ে হাঁটা পথ (ট্রেইল) রয়েছে । এই পথগুলো এবং পথ থেকে দূরে নির্দিষ্ট দূরত্বে কিছু স্থান নির্বাচন করে টেপমার্ক করা হয় এবং জি.পি.এস-এর সাহায্যে সেগুলোর স্থানাঙ্ক নিয়ে নেয়া হয় । আমাদের মূল কাজ হল প্রতিদিন বিভিন্ন দলে এই নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে গিয়ে নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের মধ্যে ১০ মিনিট ধরে পাখি স্পট করা – তাদের সংখ্যা, অবস্থা (Flying/Perching, Visual/Sound ইত্যাদী) লিপিবদ্ধ করা । স্থানগুলো আবার দুটি ভাগে বিভক্ত – ‘ডিস্টার্বড্’ (যেগুলো সরাসরি ট্রেইলের উপরে পড়ে) এবং আন্-ডিস্টার্বড্ (যেগুলো ট্রেইল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যাওয়া কষ্টসাধ্য) আমাদের মধ্যে রথীন্দ্র দা কাজ করেন প্রাইমেট নিয়ে । শিবলী ভাইয়া আর বেনেডিক্ট দার পাখি সম্পর্কে জানা-শোনা সবচেয়ে বেশি । সামিয়া আপু পড়াশোনা করেছেন বাইরে । তাই আপু, রথীন্দ্র-দা আর আমি শর্ট ও মিডিয়াম ট্রেইল গুলো আর শিবলী-ভাইয়া বেনেডিক্ট-দা কে নিয়ে লং ট্রেইল (যেটাতে আন্-ডিসটার্বড্ স্থা
ন বেশি) গুলো কাভার করার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
পাখি স্পটিং এর জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় হল ভোর বেলা থেকে শুরু করে সকাল ১০টা অবধি । প্রথম দিন আমাদের শুরু করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা দেরী হয়ে গেল । হয়তো মেঘলা আকাশের জন্য আমাদের জি.পি.এস সিগনাল পেতে সমস্যা হচ্ছিল । শর্ট ট্রেইলের প্রথম লোকেশন STD1 দিয়েই আমরা স্পটিং শুরু করলাম । প্রথম স্পটটিতে পাওয়া গেল সেপাই বুলবুলি (Red Whiskered Bulbul), দুই ধরনের বসন্তবউরি (Blue Throated Barbet, Coppersmith Barbet), দাড় কাক (Large Billed Crow), কালো ফিঙে (Black Drongo) আর ছোট্ট একটি প্যাঁচা (Asian Barred Owlet)। এক দল সাত ভায়লাকে (Jungle Babbler) দেখা গেল তাদের স্বভাবসুলভ ‘ক্যাচাল’ করে যেতে । প্রথম লোকেশনের দশমিনিটে অতি পরিচিত পাখিই দেখা গেল শুধু । স্পটিং শেষ হতে না হতেই দেখা হল প্রিয় লেখক আনিসুল হকের সাথে । বন্ধুদের সাথে তিনিও চলে এসেছিলেন সেদিন প্রকৃতির টানে । ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল খুব সহজেই যাতায়াত করা যায় N2 জাতীয় মহাসড়ক হয়ে মাত্র ৩.৫ ঘন্টায় । তাই সপ্তাহান্তে প্রকৃতির সান্নিধ্যে লাউয়াছড়া ছুটে যাওয়া অসম্ভব নয় মোটেও! আমাদের কাজ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করে আমরা পরের অবস্থানের দিকে এগিয়ে গেলাম । শর্ট ট্রেইলের পরের জায়গাটা ছিল বাঁশঝাড়ে পরিপূর্ণ । মনে মনে আশা করেছিলাম সেখানে সবুজ ঘুঘু (Emerald Dove) বা হরিয়ালের (Green Pigeon) দেখা পাব । পরের স্পটটিতেও দেখা হল বসন্ত বউরিদের সাথে । এছাড়া শব্দশুনে চেনা গেল ছোট্ট পাখি মোচা টুনিকে (Little Spiderhunter) । মিশ্র চির হরিৎ বনের Common Resident এরা। অচেনা ডাকগুলো রেকর্ড হতে থাকল সাথে থাকা রেকর্ডারে। একে একে তিলা ঘুঘু (Spotted Dove), হলদে পাখি (Black Hooded Oriole), সোনালী কাঠঠোকরার (Black-Rumped Flameback) দেখা মিলল। লাউয়াছড়ার মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে ঢাকা-সিলেটগামী রেলপথ । কোম্পানী আমলে চাবাগানের সাহেবদের সাপ্লাই পৌঁছানো ছিল এর কাজ । বর্তমানে পর্যটনবান্ধব হলেও এটি বন্যপ্রাণীদের জন্য কতোটা সুবিধার সৃষ্টি করছে বলা মুশকিল। যা হোক, রেলপথ বেয়ে আরো দুটি লোকেশনে স্পটিং করা হল । নতুন মিলল পাতা বুলবুলি (Golden-fronted Leafbird) আর নীল টুনি (Purple Sunbird)। এরপর আমরা চলে গেলাম মিডিয়াম ট্রেইলের মধ্যে । নজরকাড়া কালো কাঠবেড়ালীর (Orange-bellied Himalayan Squirrel) দেখা পেলাম আমরা কমলগঞ্জের রাস্তা পেরিয়ে। দারুণ কসরত দেখিয়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একটি সাপ খাউরি বাজ (Common Kestrel)। কানাকুক্কা (Greater Coucal) আর বউ-কথা-কও (Indian Cuckoo) পাল্লা দিয়ে ডেকে যাচ্ছিল চারপাশে। হাজার ধরণের শব্দে পুরো জঙ্গলটাকে জীবন্ত মনে হচ্ছিল । নয়টা বাজতে না বাজতেই সেই শব্দের সাথে যোগ হল উল্লুকদের (Hoolock Gibbon) ঐকতান। খুব ইচ্ছে থাকলেও কাজের কারণে সেই শব্দকে পিছু করতে পারলাম না আমরা। প্রায় দশটা বেজে গেল। তখন। বিভিন্ন প্রজাতির নজরকাড়া অর্কিড আর হাজার রকমের কীট-পতঙ্গ মাতিয়ে রাখছিল চারপাশ। অপর দলের সাথে যোগাযোগ করে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। নিসর্গের স্টুডেন্ট ডর্ম দেখে আবার চললাম শ্রীমঙ্গলের দিকে। সবার মাঝে কিছুটা হতাশা। হয়তো বৃষ্টির কারণে বার্ড অ্যাকটিভিটি তুলনামূলক ভাবে কম ছিল। হঠাৎ সেই হতাশা দূর করে দিয়ে রাস্তার পাশের লম্বা শাল গাছে সামিয়া আপু স্পট করলেন একটি উল্লুক পরিবারকে- পুরুষ, স্ত্রী এবং কোলে ছোট্ট শিশু! গাড়ি থেকে নেমে স্ন্যাপ নিলাম আমরা। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিশ্বজুড়ে এরা বিপন্নপ্রায় প্রজাতি, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় গ্রুপ মেলে
লাউয়াছড়াতেই। এরা সারাজীবন গাছেই কাটায়। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এদের আবাসস্থলকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। উল্লুক নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা শেষে তখনকার মতো আমরা ফিরে এলাম। বিকেলে আবার লাউয়াছড়ায় ফিরে যেতে হল জরিপের কাজ করতে। মূল উদ্দেশ্য ফরেস্টের অভ্যন্তরের খাসিয়াপুঞ্জির বাসিন্দাদের কাছে বন্যপ্রাণী এবং বনজ উদ্ভিদের উপর পর্যটনের প্রভাব সম্পর্কে অভিমত চাওয়া। এ বিষয়ে অভিমত বিভিন্নরকম হলেও গাছ-পালা নিধনের জন্য যে পাখিসহ অন্যান্য জীবের সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে এ বিষয়ে তারা সবাই একমত।
পরদিন আমাদের সাথে যোগ দিলেন জা.বি. এর গ্রাজুয়েট আনু এবং জাহাঙ্গির ভাইয়া। ফলশ্রুতিতে আমরা তিনটি দলে বিভক্ত হতে পারলাম। পরদিন ভোর ছয়টায় শুরু হল আমাদের অভিযান। আমার সাথে সামিয়া আপু। লক্ষ্য এবার লং ট্রেইলের ৪টি লোকেশন, সাথে তিনটি আনডিসটার্বড্ স্পট। জি.পি.এস এর কল্যাণে সহজেই খুজেঁ পেতে লাগলাম স্পটগুলো। পাখিরাও আমাদের হতাশ করল না। দুচোখ ভরে উপভোগ করলাম ছোট্ট লাল ফুলঝুরি (Scarlet-Backed Flowerpecker), মৌটুসী (Purple-Rumped Sunbird), লালবুক টিয়া (Red-Breasted Parakeet), ট্রগোন (Red-headed Trogon), ছোট-ফিঙে/দুসাই (Bronzed Drongo), লাল সাতসহেলী (Scarlet Minivet), ধোপা জঙ্গলের (Green-Billed Malkoha) মতো সর্গীয়-সুন্দর পাখি। বেশ কিছুক্ষণ থেকে ডাক শুনে আসছিলাম একটি পাখির। হঠাৎ আবিস্কার করলাম আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে তারা এবং হাত দিয়ে ধরবার মতো দূরত্বে থেকেও আমাদের মোটেই ভয় পাচ্ছে না। তখন ঠিক চিনতে না পারলেও রোনাল্ড কালদারের পাখির ডাকের সি.ডি শুনে নিশ্চিত হয়েছিলাম এটি ছিল Abott’s Babbler । শুনেছি লেজঝোলা (Asian Paradise Flycatcher), হাড়িচাচা (Roufous Treepie) আর শ্যামা (White Rumped Shama) পাখির ডাক যাদের নাম ছেলেবেলার ছড়ায়-কবিতায় সবাই পড়ে এসেছি অথচ কখনো দেখাই হয়নি! সবশেষে দেখা পাই একজোড়া ভীমরাজের (Greater Racket-tailed Drongo)। আর বীট অফিসের সামনে এসে সিংহলেজী বানরের (Pig-tailed Macaque, Globally Vulnerable Species) বিশাল একটি দলের দেখা মেলে। একজোড়া চশমাপড়া বানরকে (Phayre’s Leaf Monkey) তাড়া করে বিরাট আমগাছের দখল নেয়া দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে আসে সময়। থেকে যায় শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা নি:স্বার্ত-উদার প্রকৃতির প্রতি। সুযোগ করে দেবার জন্য ধন্যবাদ সামিয়া সেলিম ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সায়াম চৌধুরিকে। পাখির ছবি তুলতে না পারায় কিছুটা আফসোস থেকে গিয়েছে – সবার জন্য তাই ফেসবুকে আমাদের Birds Bangladeshগ্রুপে জয়েন করবার নেমন্তন্ন রইল! অপেক্ষায় থাকব রেমা-কলেঙ্গা কিম্বা কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে অন্য কোন অভিযানের…
লেখকঃ রেজা নূর মইন, প্রকৃতিপ্রেমী, সৌখিন ফটোগ্রাফার
ছবি কৃতিত্বঃ লেখক স্বয়ং
Well-written details of Lawachara reserved forest, Mawlovibazar. Every details of the inner beauties are depicted in classic bangla, can be read as a rhythmic poem. Lots thanks to the young writer.