রাতের খাদিমনগর রিজার্ভ ফরেস্ট
খুলনা-মংলা-সুন্দরবন ট্রিপ শেষ করে সিলেট ফিরেছি মাত্র। ম্যানগ্রোভ এক্সপিরিয়েন্সের রেশ কাটেনি তখনো। ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের বন্ধুবর অনিমেষ ঘোষ আর তার পার্টনার জয়প্রকাশের সদ্য শুরু করা খাদিমনগর অ্যাম্ফিবিয়ান রিসার্চ প্রজেক্টে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য মন টানছিলো। রাতের ফরেস্ট সব সময় অন্যরকম রোমাঞ্চ!কর। ক্লাস তখনো শুরু হয়নি সেমিস্টার ব্রেকের পর। বুয়েট-খু.বি.-ও বন্ধ, সঞ্জয়-রিমনরাও চাচ্ছিলো ঘুরে যেতে। ভাবলাম, সুযোগটা কাজে লাগানো যাক, অসময়ের সুন্দরবন দর্শনের খানিকটা অতৃপ্তি হয়তো ঘোচানো যাবে ওদের।
আগে যে কয়েকবার এসেছি দিনের খাদিমে, অভিজ্ঞতা মন্দ না। আদতে হট-হিউমিড হিল ফরেস্ট। আর্দ্রতায় দিনে ট্রেকিং করা বেশ কষ্টসাধ্য। তার মাঝে কনট্যুর বাইতে হয় অনেক। সিজার ভাই আর অনিমেষের সাথে যেবার হ্যাবিট্যাট সার্ভের জন্য গিয়েছিলাম, বাঁশ-বেত, ট্রি-ফার্ণ, গর্জনের বনটিকে সত্যিই অনন্য লেগেছিলো। তবে কোনবারই ভালো এনিমাল একটিভিটি পাইনি। যা হোক। ১৬৭৭ হেক্টরের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান সিলেট শহরের উপকণ্ঠে একটি হিল ফরেস্ট। শাহ পরাণ বাবার মাজার থেকে একটু সামনে গেলে খাদিম চৌমুহুনী, সেখানথেকে প্রায় ৭-৮ কিলো ভেতরে আঁকা-বাঁকা পথে খাদিম বিট অফিস। ফরেস্টের চারিদিকেই চা বাগান। পূর্বে ছড়াগাং-হাবিবনগর, পশ্চিমে বুরজান-কালাগুল, উত্তরে গুলনী এবং খাদিম চা বাগান।
যেহেতু রাতের বন দেখার জন্য আসা, আমরা রওনা দিলাম শেষ বিকেলে। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সবাই বিট অফিসের সামনে জড়ো হলাম। মোট কতোজন সেদিন ছিলাম ঠিক মনে পড়ছে না। একেকজন একেক ফেকাল্টির কেউ ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে, কেউ ডাক্তারী কিম্বা ব্যবসায় প্রশাসন পড়ছে, সবার ঠিক কেমন লাগবে বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার একটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিলো। সেটা হল প্রকৃতির সৌন্দর্য খুব কাছে থেকে দেখে ভালবাসলে, যে যার অবস্থান থেকে ভালবাসার মূল্যটা যাতে দিতে পারে। আর বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আর তাদের প্রবাবল সমাধান নিয়ে একেকজনের ডিসিপ্লিন থেকে আইডিয়া শেয়ারিং-ও কোনভাবে কাজে লেগে যেতে পারে। অনিমেষ-জয়ের সাথে বাকীদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওরা ওদের প্রজেক্ট সম্পর্কে একটা ব্রিফ দিয়ে দিলো। ওরা কাজ করছে খাদিমনগরের উভচর প্রাণি বিশেষ করে ব্যাঙের পপুলেশান এবং ডাইভার্সিটি নিয়ে। রাত্রে বিভিন্ন সাপোর্টিং ইকুইপমেন্ট বহন করে বিভিন্ন লোকেশানে ব্যাং ধরা, মাপজোখ করে ড্যাটা এন্ট্রি করা, সব শেষে হবে অ্যানালাইসিস। অল্প সময়ের মধ্যেই অনিমেষ আর জয় ফরেস্টের ‘কোণা-কাঞ্চি’ সবই নখ-দর্পণে নিয়ে নিয়েছে। রাত্রে থাকবার অনুমতি/সুযোগ শুধু চার জনের। তাই আমাদের প্ল্যান হল আমরা মেইন ট্রেইলে না গিয়ে ২নম্বর ট্রেইল হয়ে (এই ট্রেইলটিতে আগেও গিয়েছি, এটা ঠিক পথ বললে ভুল হবে, ছড়া দিয়ে এগোনো বলাই ভালো হব) রাত নয়টা দশটা নাগাদ দোলন ভাই আর আমি-অনিমেষ-জয় ছাড়া বাকীদের গুলনীর বাগান হয়ে চৌমুহুনী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবো। ওরা ফিরে যাবে শহরে। আর আমরা চারজন আর কিছুক্ষণ কাজ করে রাতটা কোনমতে ভাঙাচোরা অফিসে কাটিয়ে সকালে বার্ডিং-এ বের হবো। বারবার এসে আমি যেই বিরল ‘মথুরা’-কে খুঁজেছি, ভাগ্য প্রসন্ন হলে তার দেখা পাবো।
২১৭ প্রজাতির গাছ এবং ৮৩ প্রজাতির প্রাণি রয়েছে খাদিমে। পোকামাকড়, সরিসৃপ আর উভচরেরা রাত্রে অ্যাকটিভ হয়। অধিকাংশই নীরিহ-বিষহীন হলেও রিমোট জায়গা বলে ট্রেকিংয়ের শুরুতেই সবাইকে সাধারণ কিছু সতর্কতা আর ফিল্ড ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেয়া হল। তবে আসবার আগেই সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলাম কীধরনের কাজ এবং পরিবেশে আমরা যাবো তার ওপর। সাপের ভয় ছিলো। সাথে পেছনে পরে যাবার ভয়ও কাজ করছিলো অনেকের। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে রাতের বনের অসাধারণ ভাইব এবং ভাইব্র্যান্স সবাইকে ইতোমধ্যে মুগ্ধ করে ফেলেছিলো। হাজার রকম পোকামাকড় আর নিশাচরের শব্দ, কখনো না দেখা বুনো আঁধার-নিশুতি কিম্বা অচেনার সম্মুখিন হবার রোমাঞ্চে সবাই যেন বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম। সবার হাতেই ছিলো টর্চ। তবে অনিমেষ-জয়ের হাতের ফিল্ড টর্চ দুটোই ছিলো মূল ভরসা। এ দুটোর আলোতেই রাতের রেইন ফরেস্টের সৌন্দর্য রীতিমত ‘হা’ করে গিলতে থেকেছি আমরা। পুরো পথটাই প্রায় ছড়া। প্রতিদিনের বৃষ্টি আর আর্দ্রতা থেকে সৃষ্ট পানি ফরেস্ট বেড চুঁয়ে এই ছড়াগুলো তৈরী করেছে। ট্রেইলে ঢুকতে না ঢুকতেই সামনে থেকে জয় প্রকাশের লাফ-ঝাঁপ শুরু! আজ রাতের প্রথম শিকার। ইউফ্লিকটিস সায়ানোফ্লিকটিস। ইন্ডিয়ান স্কিপার ফ্রগ। এই ছড়ার সবচে অ্যাবান্ড্যান্ট প্রজাতির ব্যাঙ এটাই। একটু পরপরই মিলছিলো। অনিমেষরা ডিজিটাল ক্যালিপার্সে পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙের মাপজোখ করে অভিনব এক পদ্ধতিতে ব্যাঙ গুলোকে ‘ট্যাগ’ করছিলো, যা তাদের দাবী একদম নতুন এবং ব্যাঙের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না। তারা সুতির হাল্কা সুতো ঢিলা করে ব্যাঙের কোমরে বেঁধে দিচ্ছিলো যা ব্যাংটা ‘স্টাডিড’ কী না নির্দেশ করে। অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এটা সেফ এবং স্টাডির মেয়াদ শেষে ৩-৪ মাসের মধ্যে সুতো আপনা আপনি পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে ব্যাঙের কোন ক্ষতিও হবে না।
কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম পেছনের কয়েকজন বলাবলি করছে রেডিয়াম নিয়ে। কথাটা কানে গেলে অনিমেষ হেসে খোলাসা করলো প্রকৃতির এক অদ্ভূত খেয়ালের। সব লাইট বন্ধ করা হল। হঠাত নিস্তব্ধতায় চারিদেকে তাকিয়ে আমরা শ্রেফ অবাক হয়ে গেলাম! গাছে কিম্বা মাটিতে যেন একেকটা প্রাকৃতিক বাতি জ্বলে আছে পথ দেখাবার জন্য। দেখতে একেবারে রেডিয়াম আলোর মতো। এক ধরনের ছত্রাক, দেখতে চোট্ট সাদা মাইসেলিয়াল বডি বা ব্যাঙের ছাতার মতো। অন্ধকারে রেডিয়ামের মতো জ্বলে। এদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি এখনো, খুব বেশিদিন হয়নি এই বনে দেখা গিয়েছে। ট্রাইপড বসিয়ে দোলন ভাই লং এক্সপোজারে ছবি নিলেন। অপরূপ সেই ছবি। এরপর একের পর এক ব্যাং ক্যাপচার এবং নোট করা হল। আমরাও কাজে হাত লাগালাম কেউ কেউ। শিখলাম কীভাবে ব্যথা না দিয়ে ব্যাঙ ধরতে হয় এবং কীধরনের মেজারমেন্ট নিতে হয়।
রাতের ফরেস্ট মোটেও ঘুমায় না। অধিকাংশ প্রাণিই ভীষণ ব্যস্ত। হাজার হাজার সিকাডা পোকার সিম্ফোনী শুনতে শুনতে আমরা ঘাস-ছড়া মাড়িয়ে টিলার পর টিলা পার হতে লাগলাম। মাঝে ছোট ছোট বিরতি সঠিক পথ নির্ণয়ের জন্য। ক্যানোপির জন্য জিপিএস সিগনাল পাচ্ছিলো না। এরকম একটা বিরতিতেই আমার চোখে পড়লো অনেক প্রত্যাশিত অনিন্দ্য সুন্দর একটি প্রাণীর। সাধারণভাবে স্টিক ইনসেক্ট নামে পরিচিত। এই পোকাগুলোর ডিফেন্স মেকানিজমের একটি অংশ হল এদের কেমোফ্লাজ। নাম থেকেই অনুমেয় প্রাণিজগতের এই বিস্ময়টি দেখতে অবিকল চিকন এক টুকরো ডালের মতো। সবাইকে ডেকে দেখাতেই পারিনি, এর মাঝেই এটি কীভাবে যেন ডালপালাময় আণ্ডারগ্রোথের মাঝে হারিয়ে গেল! আবার খুঁজে পেয়ে অনিমেষের ক্যামেরায় ছবি নিলাম। এর আগে শুধু টিভি চ্যানেলেই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। নিজ চোখে আবিস্কার করতে সময় লাগেনি, অনুভুঁতিও ভোলার না। ছড়া ধরে ধরে হাঁটতে হাঁটতে শতফিট একটি টিলা আর পরিস্কার আকাশ পেয়ে জিপিএস লোকেশন মিলে গেল। সামনেই গুলনী চা বাগানের সীমানা। সাথে থাকা পানির বোতল থেকে সিপ নিতে নিতে এতোক্ষণ যা দেখলাম সবাই রিভিউ করতে লাগলাম। অধিকাংশের জন্যই অসাধারণ রাতের অভিজ্ঞতা। বড় টর্চটা দিয়ে মাঝে মাঝেই আমি লক্ষ করছিলাম চম্পা আর সেগুন-গর্জন গাছগুলোর মাথার দিকে।
উদ্দেশ্য রাতের পাখি। নাইটজার কিংবা পেঁচা। আচমকা আলোয় ভয়পেয়ে এ-গাছ ও-গাছ করা দুএকটি পেঁচা চোখেও পড়লো। আরেকটা বিষয় যেটা খুব ভালো লাগছিলো সেটা হল ছড়ার জাঁদরেল সাইজের কাঁকড়াগুলোর সংখ্যা। বনের বড় প্রাণিদের জন্য অন্যতম খাবার এই কাঁকড়া। খাদিমে এর আগে এবং পরের ট্রিপে মুখপোড়া হনুমান, সিংহলেজী বানর, রিসাস বানরের দল নিয়মিত দেখেছি। বিট অফিসের সুন্দর টিলায় বসলেই এদের চাঞ্চল্য চোখে পড়ে। অনিমেষের কাছে শুনেছি বনে মেছোবাঘের পপুলেশন রয়েছে (মনে পড়লো সায়াম চৌধুরীর কথা, তার প্রিয় ‘ক্যাট’ হল এই ফিশিং ক্যাট), দেখেছি শেয়াল এবং বেজি। এছাড়া আশেপাশের লোকালয়ের মানুষরাও কাঁকড়া হার্ভেস্ট করে ছড়াগুলো থেকে। ছোট ছোট মাছ আর চিংড়িও অনেক দেখলাম ছড়াতে। পপুলেশান স্টাডি ছাড়া বলা মুশকিল হলেও আমার মনে হয়েছে এটা একটা হেলদী হ্যাবিট্যাটের ইন্ডিকেশান। যা হোক। গুলনীর কোণায় আসতে আসতেই ঝড়া পাতার আস্তরের (লিফ লিটার) নিচ থেকে জয় প্রকাশ আবিস্কার করলো আমার-অনিমেষের পছন্দের একটি ব্যাঙ “Smith’s Litter Frog/Red-Eyed Frog (Leptobrachium smithii)। আমরা শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ পেলাম ৬ প্রজাতির। এদের মাঝে ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ আর ইন্ডিয়ান স্কিপার ফ্রগই ছিল বেশি। রাত হয়ে যাচ্ছিলো। বেশি রাত হলে বাকীদের ফেরা মুশকিল হয়ে যাবে বিধায় আমরা গর্জন বাগান স্কিপ করে গুলনীর পথ ধরে চৌমুহুনীর দিকে এগিয়ে গেলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ বিদায় নিয়ে সবাইকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে অনিমেষ, জয়, দোলন ভাই আর আমি ফিরলাম বিট অফিসের পথে। দুপাশে চা বাগান আর আকাশে এক ফালি চাঁদ। স্বর্গ-সুন্দর পথটা শেষ হয়ে আসতেই বিশ্রাম, তবে কিছুক্ষণের।
বিট অফিসারের সাথে দেখা হয়েছিলো পথেই, ভালভাবে পরিচিত হলাম এবার। একইসাথে টিলাগড় ইকো পার্ক আর খাদিমের দায়িত্ব তাঁর। ফরেস্টের একদম ভেতরে মনোরম টিলার মাথায় তার টীমের নি:সঙ্গ নিবাস। বিদ্যুত নেই, আমরা উঠোনে বসে বুট থেকে কাদা পানি বের করলাম, গলা ভিজালাম টিউবয়েলের মিঠা পানিতে। হাল্কা নাশতা সেরে আমি আর অনিমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম বীটের পেছনের মেইন ট্রেইলটা থেকে ছোট্ট একটা চক্কর দিয়ে আসব। দোলন ভাইও বলল যাবেন, একা থেকে কী লাভ। জয় থেকে গেল কিছু কাজে। ও পরে অন্য কোন দিক কাভার দেবে। ছোট একটা ওয়াক, এতোক্ষণ ৫০০ প্রাইম লাগিয়ে ক্যামেরা বয়ে নিয়ে হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো আমার, দোলন ভাইও দ্বিধায় ছিলেন। শেষমেষ উনি নিলেন ক্যামেরা সাথে। চেনা পথ। এসেছি আগে বেশ কয়েকবার। ১,২ নম্বর পিলার পার হয়ে গেলাম। প্ল্যান্টেশান হয়েছে খাদিমে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে; সেগুন, ব্যামবু, চাপালিশ, চম্পা আর গর্জন। এক দিক থেকে বলতে গেলে এটা কৃত্রিম বন। কোথাও মনো, কোথাও মিক্সড কালচার। তবে চোখে পড়ার মতো একটা নিদর্শন ছিল প্রাকৃতিক ভাবে প্রাগৈতিহাসিক কালের নিদর্শন ট্রি-ফার্ণ। কোথাও ৫ ফুট আবার কোথাও ৩০ ফুট উঁচু ট্রি ফার্ণও দেখেছি। ৩ নম্বর পিলার ক্রস করে একটা পথ দুভাগ হয়ে গিয়েছে। কোন দিক দিয়ে যাবো অনিমেষ সামনে থাকায় চেক করলো। প্রথম রাস্তার মুখে গিয়ে দ্বিতীয় রাস্তার দিকে যাবার জন্য ফিরে যাচ্ছিলো। আমিও ওই পথেই যাবো তবে যাবার আগে হাতের পলিছ টর্চটা রাস্তায় ফেলতেই চোখ একদম ফিক্সড্ হয়ে গেল ঠিক প্রায় ট্রেলের উপরই ছো্ট্ট একটা ডালে। এতোটা আকাঙ্খিত বলেই হয়তো মনের চোখ ওভারলুক করে যেতে পারলো না। বলে উঠলাম ‘ও মাই গড, অনিমেষ এদিকে!’।
অনিমেষ প্রথম রাস্তাটা দেখতে যে পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে তার ঠিক ফুট তিনেক পরেই একদম মাটির লেভেলে শিকারের জন্য রীতিমত স্ট্রাইকিং পস্চারে অপেক্ষারত একটি টিয়া বোরা সাপ! অব্যার্থ ফ্লুরোসেন্ট সবুজ আর ত্রিকোণ বর্ষার ফলার (স্পিয়ারহেড) মতো মাথা নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শিকারের জন্য অপেক্ষমান পিট ভাইপার! রাতের ফরেস্টে এর আবিস্কার রীতিমতো ভয়ানক! সিজার রহমানের লাউয়াছড়া স্নেক প্রজেক্টে সাধারণত চা বাগানে পাওয়া যাওয়া এই সাপটির খোঁজে বাগানের ব্লক থেকে ব্লকে চষে বেড়িয়েছি তবে দেখা মেলেনি। কোনভাবেই আশা করিনি (নাকি করেছিলাম?) এভাবে প্রিয় সাপটির সাথে অনাকাঙ্খিত (নাকি আকাঙ্খিত) ভাবে দেখা হয়ে যাবে! মুহুর্ত ব্যয় না করে অনিমেষের কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে ছবি নিলাম টর্চ আর ফ্লাশের আলোয়। দোলন ভাইয়ের ডিএসএলআর এ বন্দী হলো অপরূপ কিছু ছবি। মুঠোফোনে সময় দেখলাম রাত ১২টা বেজে ২৯ মিনিট! পুরো আধা ঘন্টা সাপটি আমাদের উজাড় করে সুযোগ দিলো তার সৌন্দর্য হৃদয় দিয়ে উপভোগ করবার জন্য। প্রতিটি স্কেল যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। টিয়া বোরা টেম্পারেট রেইন ফরেস্টের একটি সাপ। সারা শরীর ফ্লুরোসেন্ট সবুজ। লেজের কাছে খানিকটা লাল, ঠিক যেন বাংলাদেশেরই প্রতিনিধি একটি সাপ। এরা পিট ভাইপার, চোখ এবং নাকের ছিদ্রের মাঝে হিটরিসেপ্টিভ একটি ‘পিট’ থাকে। এটি পিট ভাইপারদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় হিসেবে কাজ করে। ছোটখাটো স্তন্যপায়ীদের এরা রাতের আঁধারেও থার্মাল ইমেজ হিসেবে দেখে যা শিকার এমনকি শিকারের ফেলে যাওয়া কোন উষ্ণ ট্রেসকে ট্র্যাক করতে সাহায্য করে। র্যাটল স্নেক, ডেথ অ্যাডার, পাফ অ্যাডারের মতো সাপরাও পিট ভাইপার। টিয়া বোরা স্ত্রী সাপ দৈর্ঘ্যে ৮১০মিমি এবং পুরুষ ৬০০মিমি পর্যন্ত হয়। অধিকাংশ ভাইপার অভভিপেরাস অর্থাত বাচ্চা প্রসব করলেও টিয়াবোরা অভিপেরাস বা ডিম দিয়ে থাকে যা থেকে শিশু টিয়াবোরারা বেরিয়ে আসে। এরা বিষাক্ত, দংশনে প্রাণহানী না হলেও অঙ্গহানী হবার সম্ভাবনা রয়েছে যদি স্বল্পতম সময়ে অ্যান্টিভেনম দেহে পুশ না করা হয়। ছবি তুলতে তুলতে বিব্রত বোধ করায় বোধহয় মহাশয় তার অবস্থান ‘পরিবর্তন বাঞ্চনীয়’ বোধ করে বসেন। আমাদের সাথে হ্যান্ডেলিং টংগ ছিলোনা কিন্তু রিমোট জায়গা হলেও সুযোগটা মিস করতে চাইনি। সাহস করে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে লেজে একটু স্পর্শ করতেই সে সতর্ক হয়ে গেল। লোকালয় থেকে মাইলকে মাইল দূরে, যথেষ্ট ওয়েল বিহেভ্ড, চিন্তাশীল, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং যথেষ্ট ক্ষমতাধর একটি প্রাণির চোখের মুখোমুখি তখন দাড়িয়ে আমি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য যেন আমাদের সামনে মঞ্চায়িত হচ্ছে। সবার মুখে বার বার একটি কথাই উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘লাইফ ট্রুলি ইজ বিউটিফুল’। তাকে আর বিরক্ত করলাম না আমরা। সেও অত্যন্ত ভদ্র ভাবে ধীর গতিতে ডাল বেয়ে আমাদের চোখের আড়াল হতে থাকলো। তবে কিছুদূর গিয়েই একটি ডালে গিয়ে থেমে গেল। আমরাও পিছু ছেড়ে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম এবং ৪ নম্বর পিলারের আগেই আমরা ফিরতি পথে রওনা করলাম। তবে এতোক্ষণ যে স্বাচ্ছন্দ নিয়ে ট্রেলগুলো ক্রস করছিলাম ঝোঁপ-ঝাড় পেড়িয়ে, তা রীতিমত গায়েব হয়ে গেল। বিপদের কতো কাছ দিয়ে আমরা যে চলেছি সারারাত তা বারবার মনে আসতে লাগলো। তবে বারবার সেই অনুভুঁতিকে ঠেলে দিয়ে হাসি আর পূর্ণতা এনে দিচ্ছিলো আমাদের প্রাপ্তি। ফোনে নেটওয়ার্ক আসতেই সিজার রহমানকে ক্ষুদে বার্তায় জানিয়ে দিলাম আমাদের স্পটিং এর কথা। উনি অভিনন্দন জানাতে দেরী করলেন না। বীট অফিসে ফিরে এসে জয়কে মজা করে ছবিগুলো দেখাতে ভালোই লাগছিল তবে আফসোস হচ্ছিলো ওর জন্য (পরের ট্রিপেই মক ভাইপারের দারুণ ছবি তুলে সে তার ক্ষতি অবশ্য পুষিয়ে নিয়েছে!)।
প্রচন্ড ক্লান্তি আর ক্ষুধা নিয়ে আমরা চারজন ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বীট অফিসের ডাইনিংয়ে বসে গেলাম অনিমেষের বাসা আর পাঁচভাই থেকে আনানো খাবার সাবাড় করতে। বীট অফিসার সাহেবের আতিথেয়তা সত্যিই ভুলবার নয়। এখানে একমোডেশন অপ্রতুল। তাই ঘুমোতে না গিয়ে আমরা টিলার উপরে পাতা বাঁশের মাচানে চাপাচাপি করে শুয়ে গেলাম আর এক্সপিরিয়েন্স শেয়ার করতে থাকলাম। হিল ফরেস্টের আর্দ্র বাতাস জমে জমে শিশির হয়ে পড়ছিলো গায়ে। মশাও ছিলো প্রচুর। তা সত্ত্বেও প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরলাম চারজনই, খোলা আকাশের নিচে। সকালে তো ‘মথূরার’ খোঁজে আবার বেরুতে হবে!!
ছবিগুলোর জন্য ধন্যবাদ Dolon Archi, Animesh Ghose Ayon
লেখকঃ রেজা নূর মইন, প্রকৃতিপ্রেমী,, সৌখিন ফটোগ্রাফার
ছবি কৃতিত্বঃ লেখক স্বয়ং
Excellent work with picture illustrations, can be a part of a thesis paper in the field of natural studies.