সন্ধ্যে নামে নি তখনো, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে লাল অগ্নি গোলকটা যে কোন মুহূর্তের নোটিশে বিশ্রামে যাবে, যাত্রা বিরতির সময় হয়ে এসেছে আমাদেরও, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সাথে এই বছরের উপকূলীয় জলচর পাখিশুমারিতে এসে প্রথম কয় দিন বেশ ধকল-ই যাচ্ছে, বিশেষ করে জোয়ার-ভাটার রাজত্বে থেকে থেকেই প্রায় কোমর পর্যন্ত উঁচু আঠালো কাদা ঠেলে বিভিন্ন চরে পাখি পর্যবেক্ষণ এবং গণনা বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। সাঁঝের গোলাপি আঁধার নামার সাথে সাথেই নোঙর ফেলে সেদিনের পর থামা হবে সুবিধাজনক জায়গা দেখে।
সেই সময়ে সামনের দিগন্তে জল ছুয়ে থাকা সবুজ এক টুকরো স্বর্গ চোখে পড়ল, নাম তার চর পিয়াল ( চরের নাম কিভাবে চালু হয়ে যায় তা এক রহস্যময় ব্যাপার, দেশে কয়েকশ পাতাইল্যা চর আছে, সোনার চর আছে, রূপার চর আছে, উঁচা চর আছে, কিন্তু সরকারী ভাবে নথিবদ্ধ হবার সময় একটা নাম বেঁছে নেওয়া হয়। আবার মানুষের মুখে মুখে সাধারণত সেই চরে পদার্পণকারী প্রথম মানুষের নাম অনুসারেই সম্বোধন চলতে থাকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত চরের নাম ছিল চর ওসমান, যাকে এখন আপনারা চিনেন নিঝুম দ্বীপ নামে), কাছে আসতেই দেখা গেল ঘাসে ছাওয়া পুরো চর, আর দূরে সারিবদ্ধ করে লাগানো সবুজ বেষ্টনীখ্যাত গাছগুলো করে যাচ্ছে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা, তার সামনের ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো কালো কিছু বিশাল জন্তু!
দেখে মনে হল ভোরের সাভানার কোন দৃশ্য, কুয়াশাচ্ছন্ন সোনালী ঘাসের প্রান্তরে চরে বেড়াচ্ছে দানব কেপ বাফেলোরা, কী এ তো আমার বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগরের শরীর ভেদ করে জেগে ওঠা ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার চর পিয়াল, চিরচেনা দেশ, কিন্তু অজানা অপূর্ব দৃশ্য, শিহরণ জাগানিয়া, মনে হচ্ছে জাহাজডুবির নাবিকের বুঝি এই ধরনের দ্বীপেই আটকা পড়ে।
দলনেতা পাখিপর্যবেক্ষক ইনাম আল হক জলদি নামার তাড়া দিলেন, চর থেকে নিরাপদ দূরত্বে নোঙর ফেলে মূল নৌকা ( মাছ ধরার ট্রলার ভাড়া নেওয়া হয়েছে বরাবরের মতই ) থেকে ক্ষুদে ডিঙ্গি নামানো হল, স্থান কম ছোট সে তরীতে, তাই কয়েক দফায় যেতে হবে সবাইকে, পাখি পর্যবেক্ষকদের সাথে আছেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের একটি দল এবং চ্যানেল আইয়ের টিম। ইনাম ভাই প্রথমেই সাবধান করে দিলেন চরে বেড়াতে থাকা মহিষগুলো সম্পর্কে, সেগুলো যেহেতু মানুষে সংস্পর্শ ছাড়াই থাকে জীবনের অধিকাংশ সময় তাই সেগুলো ঠিক পোষা নিরীহ গবাদি পশু নয় বরং আধা বুনো ( Semi Wild) মাঝে মাঝেই ক্ষেপে গেলে তাড়া করে লেজ উচিয়ে, গেল বছর এক পাখি প্রেমী মহিষের তাড়া খেয়ে শেষে কোমর জলে নেমে পড়ে তারপর রক্ষা পেয়েছেন শিঙের গুঁতো থেকে, কাজেই সাবধান!
প্রথম বারেই ডিঙ্গি করে পৌঁছে গেলাম কাদার চরটিতে, মাটিতে পা দিতেই তীব্র ভাবে অনুভব করলাম ধারালো ঘাসের আঁচ, বেশ খরখরে অনুভূতি পায়ের তলার মসৃণ চামড়ায়। কাদার উপদ্রব ঠেকাতে জুতা-স্যান্ডেল সবই রেখে আসা হয়েছে, এখন এক মহাউপদ্রব। দূর থেকে দেখেও মনে হচ্ছিল সবুজ মখমল বিছানো আছে কুমারী চরের সারা অঙ্গ জুড়ে, এখন বাস্তবে দেখি পুরাই ভীষ্মের শরশয্যা! সেই কণ্টকময় ঘেসো জমি পেরিয়ে বালি ঢাকা বেলাভূমিতে যেতেই কষ্টের পুরস্কার মিলে গেল, এক একাকী ইউরেশীয় মোটাহাঁটু ( Eurasian Think-knee) প্রতীক্ষায় আছে তার জোড়ার,
চর পিয়ালে প্রথম বারের মত দেখা মিলল এই পাখির, নিঃসন্দেহে জীববৈচিত্রের জন্য দারুণ সংবাদ। ইনাম ভাইয়ের সাথে সাথে প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মুকিত মজুমদার বাবুসহ অন্যান্যরা চললেন সেই পাখিটিকে ক্যামেরাবন্দী করতে, আর আমরা কজনা চললাম উল্টো দিকে, যেখানে বসে আছে একদল পাকরা উল্টোঠুটী (Pied Avocet)।
কি অপূর্ব এই জগত! ঢাকার একজন কিশোর-কিশোরী হয়ত কোনদিন জানতেই পারবে না তার দেশেও এমন জায়গা আছে যা মনে আফ্রিকার সাভানার মত রোমাঞ্চ নিয়ে আসে, মানুষ থিক থিক করা ভূখণ্ডের যেখানে এখনও মিলতে পারে নতুন জাতের কোণ পশু বা পাখি, নরম রোদে পড়ে আছে অবসন্ন ভাবে নলখাগড়ার বনে, পাকরা উল্টোঠুটীরা হুটোপুটি করতে করতে উড়ে গেলে তাদের উপরে নিক্ষিপ্ত দৃষ্টিবাণ যেয়ে পড়ল পিছনের ঘাসের বনের লুকিয়ে থাকা কালামাথা কাস্তেচরাদের (Black headed Ibis) উপর,
তাদের অনুসরণ করার নেশায় কখন যে মহিষদলের বেশ কাছে চলে গেছি তা বলায় উপায় নেই, মহিষদের দেবতা ট্যাঁরোবারো তখন বিশ্রামে থাকায় মহিষাসুরের রূপে তাদের দলনেতা দিল এক ডাক- ঐ নচ্ছার মানুষেরা বাচ্চারা, খবরদার কাছে এলে গুঁতিয়ে দিব!
ব্যস, সোজা স্থাণু হয়ে রয়লাম যদি মহিষের চার্জ ঠেকাতে হঠাৎ দৌড় দিতে হয়, এদিকে তাদের নিনাদেই পাখির ঝাঁক উড়ে আরেকটু দূরে যেয়ে বসল, এবং কি আশ্চর্য সেই ঝাঁকে পাচমেশালি জলচর পাখির সাথে ছিল এক অতিবিরল পরিযায়ী পাখি ইউরেশীয় ঝিনুকমার (Eurasian Oystercatcher ) !! এটি ছিল বাংলাদেশে ইউরেশীয় ঝিনুকমারের ২য় অবস্থানের রেকর্ড
ছবিটি ইউরোপে তোলা, অবশ্য এই বছরই সুন্দরবনে আরও তিনটে ইউরেশীয় ঝিনুকমার দেখা গেছে), মহাআনন্দে সেই খবর নিয়ে অন্যদের কাছে এগোলাম, মহিষদের দিকে পেছন ফিরে পা টিপে টিপে।