আমের পাতায় বিষাক্ত উরুশিয়ল
গ্রামের উঠানে শুকনো আম পাতা দিয়ে রান্না করছে গৃহবধূ। ধোঁয়ায় তার চোখ জ্বলছে, গা হাত-পা চুলকাচ্ছে। রাঁধুনী ভাবেন, আগুনের পাশে স্বাভাবিক তিন প্রক্রিয়া তো চলতেই থাকে, এগুনো-পেছুনো আর চুলকানো। কিন্তু আমপাতা, আমের লাকড়ি চুলোয় ঠেলার পরে মাত্রাটা যেন অনেক বেড়ে যায়। ব্যাপারটা আমল দিই না আমরা। সব দোষ আগুনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বহুকাল কাটিয়েছি আমরা।
আমের বোঁটার কষ ঠোঁটে- থুতনিতে লেগে গেলে চুলকোতে থাকে। তিনদিন পর্যন্ত এর প্রভাব থাকে, কখনো ফোস্কাও পড়ে যায়। এর পেছনেও আছে একই কারণ। আম পাতার ভেতরে থাকে উদ্বায়ী তেল উরুশিয়ল। আগুনে পুড়ে ধোঁয়ার সঙ্গে এটা চলে যায় ফুসফুসে, সেখান থেকে মিশে যায় রক্তে। এরপর শরীরের যে কোনো জায়গায় চুলকাতে থাকে, লাল হয়ে যায়, কখনো ফুলে ওঠে চাকা চাকা হয়ে। এমন কি যে ছেলে মায়ের আঁচলে মুখ মোছে তারও হতে পারে একই দশা। এই উরুশিয়ল আমের পাতা বা খড়িতে শুধু নয়, আমের ভেতরেও থাকে। তবে আমের ভেতরে যা থাকে তা খুব সামান্য পরিমাণ, এত সামান্য যে যিনি উরুশিয়ল সেন্সিটিভিটি, তিনিও খেতে পারেন ফলটি। কিন্তু খোসা ছড়িয়ে দিতে হবে অন্য কাউকে। ছেলেবেলা থেকে যারা আম্র-পরিবেশে বাস করেন তাদের বেশ খানিকটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে উরুশিয়ল-এর বিরূদ্ধে, কিন্তু সমস্যা হয় শাহরিকদের নিয়ে যাদের সাথে আমের সম্পর্ক থাকলেও আমবাগানের নেই।
জরিপে দেখা গেছে শাহরিকদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০% এর কম নয়। উরুশিয়ল শব্দটির মধ্যে বাংলা গন্ধ আছে। আমার পরিচিত একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান তো আরেকটু আত্তীকরণ করে এর নাম দিয়েছিলেন উরুশিয়াল। এই শব্দটি তার মাথায় আসার একটি কারণও ছিল। তার কাছে যে রোগিনী এসেছিলেন তার দুই উরুতে ছিল উরুশিয়লের ভয়াবহ আক্রমণ। শীতকালে আইলার ওপর আমের খড়ির অঙ্গারে আগুন তাপাতে গিয়েই তার এ দশা হয়েছিল। যা হোক, শব্দটি বাংলা- বাংলা মনে হলেও আদতে জাপানী কারণ বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জাপানীরাই ল্যাকার গাছ থেকে প্রথম আবিষ্কার করেছে এই বিষাক্ত হলুদ রসায়ন। এই রসায়ন বিশ্বের সামান্য যে কয়েকটি গাছে পাওয়া যায় তার মধ্যে আছে পয়জন আইভি, পয়জন ওক ও সুমাক। আমগাছ ছাড়া উল্লেখিত সবই বিদেশী। বনে বাগানে খেলতে গিয়ে, পিকনিক করতে গিয়ে, অনেকেই শিকার হন আকর্ষণীয় লাল পাতা পয়জন আইভির। বিশেষ করে বাচ্চারা এই আইভির পাতা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে অজান্তে মেখে নেয় সারা গায়ে যা মালী আর কাঠুরিয়াদের তেমন ক্ষতি করতে পারে না।
হাওয়াই দ্বীপের ল্যাণ্ডস্কেপিং-এ খুব সাবধানে বহুল আলোচিত পয়জন আইভি, পয়জন ওক বা সুমাক গাছকে এড়িয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিন্তু আমের ভেতর এর প্রচণ্ড উপস্থিতি তাদের নাস্তানাবুদ করেছে। প্রতি বছর আম পাকার মৌসুমে এই বিষের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এখন বক্তব্য হল, এই উরুশিয়ল সমস্যার প্রতিকার চাই, অন্তত দেশজ কিছু প্রতিকার যা হাতের কাছে পাওয়া যেতে পারে। উরুশিয়ল সম্পূর্ণ দেহের ভেতর ঢুকতে সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট। আর এর প্রভাব থাকতে পারে ৩ দিন বা তারও অধিক। অতএব শরীরের কোথাও আমের কষ লাগলে বা আমপাতার সংস্পর্শ নিবিড় হলে সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে ফেলতে হবে জায়গাটা। ভিনেগার এবং সামান্য গরম পানি দিয়ে ধুতে পারলে আরো ভাল। এরপর জায়গাটিতে হলুদ অথবা খাইসোডার পেস্ট লাগিয়ে দিতে হবে। গ্রামের মানুষকে ব্যবহার করতে দেখেছি তিসি বা মসিনার তেল, যা শহরে দুর্লভ। ঐ তেল লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে চুলকানি বন্ধ হয়ে শীতল একটা অনভূতি এনে দেয়।
আমাদের দেশে অনেকে ঘরে হোমিওপ্যাথি প্র্যাক্টিস করেন, যার ফল প্রতিবেশীরাও কম বেশি পেয়ে থাকেন। এই ওষুধের বাক্সে পাওয়া যেতে পারে রাস টক্স [Rhus Toxicodendron-Poison Oak-Ivy] নামে একটি ওষুধ যা তৈরি হয় পয়জন আইভি থেকে। এর কয়েকটি বড়ি জলে গুলে লাগালে খুব উপকার হয়। প্রকৃতিতে এমন কিছু ক্ষেত্রে আমরা অ্যান্টিডট দেখতে পাই, যেমন চুত্রাপাতার চুলকানি নিরাময়ে তার পাতাবাঁটার প্রয়োগ, বৃশ্চিকের হুলের ব্যথা নিরসনে হুল কেটে ফেলে দেহের পেস্ট লাগানো ইত্যাদি।