অর্গানিক ফার্মিং ও খাদ্য নিরাপত্তা

মানুষ আজ দু’টো বিষয়ে চিন্তিত। এক, জলবায়ু পরিবর্তন, দুই, খাদ্য নিরাপত্তা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যশস্য উত্পাদনে প্রভাব পড়ছে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিযোগিতা ভিত্তিক কৃষি উত্পাদনের জন্য গুণগতমান যাচাই-বাছাই না করেই তার উত্পাদন চলছে। এজন্য সব জায়গাতে উচ্চারিত হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যকে অটুট রেখে জৈবিক ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব ফসল উত্পাদনে অর্গানিক ফার্মিং এর কথা। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, পৃথিবীতে ৩০.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জৈব কৃষি বা অর্গানিক ফার্মিং হয়, যা পৃথিবীর চলমান আবাদি জমির ২ ভাগ। এই পদ্ধতিতে উত্পাদিত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হয় বছরে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাইব্রিড বা উচ্চফলনশীল খাদ্য দ্রব্য উত্পাদন এবং ভোগ করে মানুষের শারীরিক ধরণ “ব্রয়লার মুরগির বডি স্ট্রেন্থ” এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কেননা খাদ্য দ্রব্য উত্পাদন করতে গিয়ে যে কৃত্রিম সার, ওষুধ বা বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব শুধু মাটি, জল, পরিবেশ দূর্ষিত করছে না তা মানব স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি করছে। যে কারণে মানুষের নিত্যনতুন রোগ শিকার হতে দেখা যাচ্ছে।

header_image-01

প্রতিদিনের ফেলে দেয়া শাকসবজির উচ্ছিষ্টাংশ, গবাদি পশুর পরিত্যক্ত মলমূত্র, আবর্জনা, সহজে উত্পাদনে সক্ষম গাছপালা, খৈল এমনকি প্রকৃতির লাঙল কেঁচো দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জৈব সারের ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান অক্ষুন্ন থাকবে, অন্যদিকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ কোনো ঝুঁকি থাকবে না। পৃথিবীর উন্নত দেশ আমেরিকার দিকে তাকালে দেখা যায়, এক সময় সেখানে মাংসের তৈরি খাদ্যের চাহিদা ও দাম বেশি ছিল, আর এখন সবজির তৈরির খাবারের দাম ও চাহিদা বেশি। মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে, কৃত্রিমতার সাথে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা নয়, প্রকৃতির নিয়মে চললে মানুষ বাঁচে বেশি দিন। প্রতিনিয়ত ফসল উত্পাদন করতে কীটনাশক, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করাতে কৃষি ক্ষেতের উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। মাটি, জল, বায়ু, আলো যে স্বকীয়তা নিয়ে কৃষি উত্পাদনে অবদান রাখার কথা, তা না হয়ে এ ক্ষেত্রগুলো আজ অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিশাল জলজ সম্পদে সৃষ্ট প্রাণিজ প্রোটিন আমাদের প্রয়োজনের অনেকটাই পূরণ করে। এ ক্ষেত্রে যদি জলাশয়, পুকুর বা হাওর বাঁওড়ের মাছ উত্পাদনে কৃত্রিম বা রাসায়নিক উপযোগ ছাড়া প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগানের মাধ্যমে করা যায়, তাহলে অল্প যোগানে পরিপূর্ণ ও অটুট প্রোটিন আসতে পারে সেখান থেকে। পুকুরে রাসায়নিক সারের ব্যবহারে সুবিধাগুলোর বিপরীত ফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রকৃতিগত শক্তি স্থায়ী এবং ভাল। বছর বছর রাসায়নিক বা অজৈব সার ব্যবহারের ফলে পুকুরের মাটিতে অম্লত্ব বেড়ে যায়। এই অম্লত্বকে চুন প্রয়োগ করেও রোধ করা যায় না। তবে জৈব সারের ব্যবহারের জন্য যে অম্লত্বের সৃষ্টি হয় তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এছাড়া রাসায়নিক বা অজৈব সারের ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক কোনো খাদ্য সৃষ্টি হয় না। তবে ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা সৃষ্টি হয় ব্যাপকভাবে। যে জন্য পুকুরের জল সব সময় সবুজ থেকে ঘন সবুজে পরিণত হয়। এই জলে ক্ষুদ্র প্রাণিকণার জন্ম হয় না। এক পর্যায়ে তলদেশে শ্যাওলার জন্ম হয়ে তা থেকে নিঃসরিত রসের জন্য মাছের জীবন ধারণ করা সম্ভব হয় না। এভাবে ব্যাপক শ্যাওলা সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণার জন্ম নেবার ফলে তলদেশে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না। যে জন্য এক পর্যায়ে তলদেশের ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা মরে পচে যায়। এ ভাবে তলদেশে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমতে কমতে শেষ হয়ে যায়। তখন মাছ অক্সিজেনের অভাবে মরে ভেসে ওঠে। কাঙ্খিত উত্পাদন না পেলেই পরিবেশের পরিবর্তিত ধারাকে আমরা দোষারোপ করি। অথচ রাসায়নিক সারের ঝুঁকিটা গিয়ে ঠেকেছে অনেক দূর পর্যন্ত। এতে আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ছাড়াও এর প্রভাবে বিলুপ্ত বা অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে স্থল ও জলজ প্রাণী, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ। অর্থাত্ ক্ষতিকর রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জীববৈচিত্র ধরে রাখতে পাড়ছি না।

জৈব সারে কৃষক উত্পাদনে গেলে লাভবান হওয়া যেমন সহজ, তেমন চাষের জমিও ভাল থাকে। অপর দিকে রাসায়নিক বা অজৈব সারে পুকুরের মাটি, জলের উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। পক্ষান্তরে ফলন কম আসে। কেননা মানব জাতির জীবনচক্রে রাসায়নিক সারের প্রভাব ক্ষতিকর। প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে যে খাদ্য আমরা খেয়ে থাকি তার মধ্য দিয়ে যদি রাসায়নিক সারে উত্পাদিত কোনো খাদ্য শরীরে প্রবেশ করে, তবে ওই সারের ক্ষতিকর প্রভাবে আমরাও প্রভাবিত হই। মনে রাখতে হবে মানুষের জীবন নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষার বলয় তৈরির জন্য অর্গানিক ফার্মিং এর জৈব সারের ব্যবহার যতটা না সহজ ও সাবলীল, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে উত্পাদিত ফসল তার চেয়ে বেশি হুমকি স্বরূপ।

গৌতম কুমার রায়
লেখক:কৃষি প্রাবন্ধিক

http://www.ittefaq.com.bd/

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics