বৈশ্বিক উষ্ণতা পরিমাপে "কার্বন ফুটপ্রিন্ট"

তানভীর হোসাইন হাসান

বায়ুমন্ডলে আজ বিভিন্ন ধরনের গ্রীন হাউজ গ্যাস সর্বচ্চো মাত্রার অধিক পরিমানে বিরাজ করছে যা প্রানীজগতের অস্তিত্বের  জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে। এই গ্যাসসমুহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দেশ, সংস্থা, অনুষ্ঠান, ব্যাক্তির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলে নিঃসরিত হচ্ছে। যাতায়াত, বাসস্থান, খাবার দাবার ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা গ্রীন হাউজ গ্যাস পরিবেশে নিঃসরণ করছি যা পারতপক্ষে জলবায়ুর পরিবর্তন আরো ত্বরান্বিত করছে। এই নিসঃরিত গ্যাসসমুহের মধ্যে বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন এর পরিমান নির্ণয়ের জন্য কার্বন ফুটপ্রিন্ট বা কার্বন পদচিহ্ন হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি। কোন নির্দিষ্ট বস্তুর নিঃসৃত সম্পুর্ণ কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করা একটি অসম্ভব কাজ যেখা্নে প্রাকৃতিক উৎস থেকে নিঃসৃত কার্বনও যোগ হতে পারে। এই কারনে রাইট, কেম্প এবং উইলিয়ামস তাদের প্রকাশিত জার্নালে লিখেছেন, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, প্রক্রিয়া অথবা কর্মক্ষেত্রের পারিপার্শ্বিক পুরো সীমানায় আ্নুষংগিক সকল উৎস, সংগ্রাহক এবং ধারক বিবেচনায় নিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেনের মোট পরিমানকেই উক্ত অঞ্চলের কার্বন ফুটপ্রিন্ট বা কার্বন পদচিহ্ন বলে। একশ বছরের বৈশ্বিক উষ্ণতার সম্ভাবনায় কার্বন ডাই অক্সাইড সমতুল্যতায় এর পরিমাপ করা হয়। গ্রীন হাউস গ্যাস সাধারনত পরিবহন, খাদ্যের উৎপাদন ও ভোগ, জ্বালানী, উৎপাদিত পণ্য, পদার্থ, কাঠ, সড়ক, ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কার্যাবলীর মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। কার্বন পদচিহ্ন ধারনাটির উৎপত্তি হয়েছে বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন থেকে যা ১৯৯০ সালে ওয়াকারনাগেল এবং রীজ কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছে। কার্বন পদচিহ্ন বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন অপেক্ষা অধিকতর সুনির্দিষ্ট কারন এর মাধ্যমে গ্যাসসমুহের সরাসরি নিঃসরন পরিমাপ করা হয় যা বায়ুমন্ডলের জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি সম্পৃক্ত।Carbon-Footprint

ব্যক্তি, জাতি বা সংস্থার নিঃসরিত গ্রীন হাউস গ্যাস সমুহের পরিমান নির্ধারন অথবা কার্বন হিসাবরক্ষন  ক্যালকুলেটরের মাধ্যমে কার্বন পদচিহ্ন পরিমাপ করা যায়। কার্বন পদচিহ্নের আকার যদি জানা যায়, তবে এটি হ্রাসে কৌশলও দ্রুত উদ্ভাবন করা যাবে যথা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উন্নত প্রক্রিয়া এবং পন্য ব্যবস্থাপনা, কার্বন করায়ত্তকন, ভোগের কৌশল পরিবর্তন ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের অনলাইন ভিত্তিক কার্বন পদচিহ্ন ক্যালকুলেটর রয়েছে যেখানে ব্যক্তির খাবার দাবার, পরিবহন পছন্দ, বাসস্থানের আকার, কেনাকাটা ও বিনোধনমুলক কার্যাবলী, বিদ্যুতের ব্যবহার, তাপের উৎপাদন এবং ভারী যন্ত্রপাতি যেমন ড্রায়ার ও রেফ্রিজারেটর ইত্যাদির ব্যবহার সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। উক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তরের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ ব্যক্তির কার্বন পদচিহ্নের মান প্রদান করে। কার্বন পদচিহ্নের নিবৃত্ত হিসেবে বিকল্প প্রকল্প যেমন সৌর বা বায়ুশক্তির ব্যবহার, পুনর্বনায়ন ইত্যাদির উন্নয়ন সাধন যা কার্বন পদচিহ্ন হ্রাসের একটা পথ তুলে ধরে যাকে কার্বন সমতাকরন হিসেবে অভিহিত করা হয়। কার্বন পদচিহ্ন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কোনো দেশের জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সফলতা, অর্থনিতির শক্তি এবং কার্বন প্রবলতার উপর। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্বন পদচিহ্ন কমানোর প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে উক্ত উপাদানসমুহের স্বাভাবিক গতিকে ত্বরান্বিত করা। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, কোনো ক্ষেত্রে কার্বন পদচিহ্ন কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমান কমানো বা কার্বন নিঃসরনকারী জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস করা।

কার্বন পদচিহ্নের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রত্যহ জীবনে কী পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন করছি তা জানতে পারি। কর্মক্ষেত্রে গমন, একটি লাইট প্রজ্জ্বলন এমনকি ভ্রমনসহ সকল ক্ষেত্রে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানী যেমন তেল, কয়লা বা গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। জীবাশ্ম জ্বালানী জালানোর সময় গ্রীন হাউস গ্যাস যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরিত হয় যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান রাখে। বায়ুমন্ডলের ৯৮% কার্বন ডাই অক্সাইডই জীবাশ্ম জ্বালানীর দহন থেকে আসে। পরিবেশ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সচেতন ব্যক্তিগন তাদের বসতি অঞ্চলের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে ও গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে কার্বনের উৎপাদন কমানোর চেষ্টা করে। কেউ কেউ ব্যক্তিগত কাজ শুরুর আগে কার্বন পদচিহ্ন পরিমাপ করে নেয় যেমন করে খাদ্যগ্রহনের আগে ওজন মেপে নেয়। কার্বন পদচিহ্ন একটি সাধারন সংখ্যা নির্দেশ করে যা ব্যক্তি কর্তৃক মাসিক বা বাৎসরিক নিঃসৃত কার্বনের পরিমান এবং যা পরিমাপ করা হয় টন হিসেবে। বর্তমানে কিছু বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের পন্যের গায়ে লাগানো লেবেল কার্বন পদচিহ্ন নির্দেশ করে দেয় যাতে করে ভোক্তা তার ব্যবহৃত পন্যের মাধ্যমে নিঃসৃত কার্বনের পরিমান জানতে পারে এবং উক্ত পন্যটির পরিবেশগত সমর্থন জানাতে পারে। উক্ত মানের মধ্যে রয়েছে পন্যটির উৎপাদন, মোড়কায়ন, পরিবহন ও হস্তান্তরের সময় নিঃসৃত কার্বনের মোট পরিমান। কার্বন পদচিহ্নের ব্যবহার যদি সকল ক্ষেত্রে এরুপ উপযোগিতা পায় মানষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে যার ফলে পরিবেশে নিঃসৃত কার্বনের পরিমান উল্লেখযোগ্য হারে কমানো যাবে। পরিবেশের সুস্থতা রক্ষে সরকারীভাবে সকল পন্যের লেবেলে কার্বন পদচিহ্নের ব্যবহারকল্পে্ একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রনয়ন এবং একটা গ্রহনযোগ্য মান নির্ধারন করা প্রয়োজন যাতে করে কোনো প্রতিষ্ঠানই পরিবেশের ক্ষতি করে পন্য উৎপাদন করতে না পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics