গ্রিন টেকনোলোজির আদ্যোপান্ত – ২

তানভীর হোসেন

নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে বর্তমান পরিস্থিতিঃ

২০০৪ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বার্ষিক ১০-৬০% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিক বিষয়টিকে নিম্নভাবে উপস্থাপন করা যায়ঃ

নির্বাচিত বৈশ্বিক নবায়নযোগ্যশক্তির উদ্দিপক ২০০৮ ২০০৯ ২০১০ ২০১১
নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা(সমসাময়িক)(GWe) ১১৪০ ১২৩০ ১৩২০ ১৩৬০
পানিবিদ্যুৎ ক্ষমতা(সমসাময়িক)(GWe) ৮৮৫ ৯১৫ ৯৪৫ ৯৭০
নতুন নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য বিনিয়োগ(বার্ষিক)(10^9USD) ১৩০ ১৬০ ২১১ ২৫৭
বায়ুশক্তি ক্ষমতা(সমসাময়িক)(GWe) ১২১ ১৫৯ ১৯৮ ২৩৮
সৌর উষ্ণ পানির ক্ষমতা(সমসাময়িক)(GWth) ৭৯ ৮৯ ৯৮ ১১৮
নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে দেশসমূহের লক্ষ ৭৯ ৮৯ ৯৮ ১১৮
ইথানল উৎপাদন(বার্ষিক)(10^9litres) ৬৭ ৭৬ ৮৬ ৮৬
সোলার ফটোভোল্টায়িক ক্ষমতা(GWe) ১৬ ২৩ ৪০ ৭০
জৈবডিজেল উৎপাদন(10^9litres) ১২ ১৭.৮ ১৮.৫ ২১.৪

 

বায়ু বিশুদ্ধকরন

বাড়ির অভ্যন্তরীন বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য কিছু মৌলীক ও সাধারন উদ্ভিদ যেমন Dypsis Lutescens, senseviera trifasciata, epipremnum aureum লাগানো যায় কারন সকল উদ্ভিদ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষন করে এবং বায়ুতে অক্সিজেন প্রদান করে।

 

সবুজ প্রযুক্তিঃ প্রধান দশটি ব্যবহারকারী দেশ

Cleantech group এবং WWF এর প্রকাশিত রিপোর্টে যেসকল দেশ সবুজ প্রযুক্তির ধারনাকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনশীলতার চর্চা করছে তার একটি প্রতিফলন পাওয়া গিয়েছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন গত ২০০ বছরে ভোক্তার জীবন ধারন পদ্ধতি ও উৎপাদনশীলতার অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটানোর কারনে একবিংশ শতাব্দীতে সহনশীলতার বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার লক্ষে সবুজ প্রযুক্তি একটি অত্যাবশ্যকীয় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। green

Cleantech group এবং WWF সবুজ সমাধান কোম্পানীগুলোর প্রসারন যথা সরকারী নীতিনির্ধারন, অর্থনৈতিক বেসরকারী উদ্দীপক, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দীপক, বেসরকারী বিনিয়োগ এবং নিবন্ধিত পরিবেশ কাঠামো প্রভৃতির সাথে সম্পর্কিত ১৫টি নির্দেশকের ভিত্তিতে ৩৮ টি দেশকে নিরীক্ষা করে।

“ global cleantech innovation index” এর জরিপে দেখা যায়, নবায়নযোগ্য শক্তি হচ্ছে সবুজ বিনিয়োগের প্রধান নিয়ামক। ২০১০ সালের প্রায় ৭৭% বিশ্ব বিনিয়োগই নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় দশটি দেশ হচ্ছেঃ

১। ডেনমার্কঃ মজার ব্যাপার হল, সবুজ উদ্ভাবনশীলতার র‌্যাংকিংয়ে ছোট দেশগুলোই সহনশীল ভবিষ্যতের লক্ষে আরো বৃহৎ পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আছে।এক্ষেত্রে ডেনমার্কের নেতৃত্ব ব্যাখ্যা করা যায়,  সেদেশের সবুজ প্রযুক্তি সচেতন প্রতিষ্ঠানের বিপ্লবী প্রসারন এবং যতক্ষন না পর্যন্ত এগুলো অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত উভয়ভাবে লাভবান হয়। ডেনমার্কে বায়ুশক্তি হচ্ছে সবছেয়ে অগ্রগামী ক্ষেত্রগূলোর একটি এবং ২০২০ সালের মধ্যে বিকিরন হার ৪০% কমানোর লক্ষে সরকারী পরিকল্পনা অনুসারে তারা প্রত্যাশা করছে বায়ুশক্তি তাদের আগামী দশকের প্রয়োজনীয়  শক্তির অর্ধেকেরও বেশি যোগান দিবে। পথ প্রদর্শক হিসেবে এটা উল্লেখযোগ্য যে, রাজধানী কোপেনহেগেনই বিশ্বের প্রথম শহর যেখানে সর্বপ্রথম সরকারীভাবে বাইসাইকেল ভাড়া দেয়া হতো যা পরবর্তীতে বিভিন্ন বড় শহর যেমন বার্সেলোনা, বার্লিন, প্যারিস ও রিও ডি জেনিরোতে অনুসরন করা হয়।

২। ইসরায়েলঃসীমিত পানি এবং অপ্রতুল শক্তির ব্যবহারে ইসরায়েল ৫০ এর দশক থেকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জীবাশ্ম জ্বালানী এবং পাশ্ববর্তী তেল উৎপাদনকারী দেশসমুহেরসাথে বন্ধুত্বপুর্ন সাহায্য ছাড়াই উক্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষে দেশটি সূর্যের দিকেই নজর দিয়েছে। বর্তমানে ইসরায়েলের ৯০% বসতবাড়িই পানি উত্তপ্ত করতে সৌরশক্তি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিটি সারা বিশ্বেই স্বীকৃত এবং ইসরায়েলই একমাত্র দেশ যারা পানির পরিশোধন ও পুনর্ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে।

৩। সুইডেনঃ সকল নির্দেশকের নিরিখে সুইডেন র‌্যাংকিংয়ে তিন নম্বর অবস্থানে রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, গবেষণা এবং পরিবেশ উপযোগী প্রযুক্তির উন্নয়নে সুইডেন সরকার বৃহৎ অনুদান প্রদান করে। পরিবেশগত বাধা বিপত্তি মোকাবিলায় দেশটির কেন্দ্রের সাথে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমুহের জবাবদিহিতামুলক কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে। সবুজ বসতি হতে প্রযুক্তিগত চক্রায়ন এবং অপচয়কৃত শক্তি যেগুলো ৮০% সুইস বসতি উষ্ণায়নের জন্য দায়ী সেগুলো সহ বর্তমানে দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবেশগত সমাধানের প্রসংশা মুলক অগ্রগতি রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুইডেন বিশ্বে সবচেয়ে অগ্রগামী।

৪। ফিনল্যান্ডঃ   তালিকার চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ক্ষুদ্র নর্ডিক কান্ট্রি ফিনল্যান্ড যা পরিবেশগত সমাধানের পরিক্ষাগার হিসেবে কাজ করে। শুধুমাত্র ২০১০ সালেই দেশটি পুরো বিশ্বের ৫.৬% নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করেছে যা ১৭.৯ বিলিয়ন ডলার আয় করে। সম্প্রতি ব্রাজিল ফিনল্যান্ডের সাথে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার চুক্তি করেছে। দুই দেশের মধ্যে স্থল প্রযুক্তির বিনিময়ের চুক্তি হয়েছে, কারন ফিনল্যান্ড জাহাজ নির্মানশিল্প এবং তেলশোধনাগারে স্বীকৃত ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে প্রসিদ্ধ।

৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রঃ র‌্যাংকিংয়ে ৫ম অবস্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১০ সালের ৫.২ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড় ভেঙ্গে ২০১১ সালে ৬.৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উক্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে যা বিগত বছরের তুলনায় ৩১% বেশি। আমেরিকান প্রদেশগুলোর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়াই এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। বিগত বছর তারা ৫৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এই ক্ষেত্রে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিনিয়োগের ৫৪%।

৬। জার্মানীঃ জার্মানীর নামটা উল্লেখ না করে আমরা সবুজ উদ্ভাবন বিশেষত নবায়নযোগ্য শক্তির বিষয়ের অবতারনা করতে পারবোনা যারা cleantech এর র‌্যাংকিংয়ে ৬ নং অবস্থানে রয়েছে।দেশটি ২০২২ সালের মধ্যে পারমানবিক চুল্লীর ব্যবহার বন্ধে এবং নতুন উৎস বিশেষত, সৌর ও বায়ুশক্তি দ্বারা তা প্রতিস্থাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্ব বায়ুশক্তি সংস্থার জরিপ মতে, জার্মানী ৩য় প্রধান দেশ যারা ২৯০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুতের জন্য বায়ুশক্তির পিছনে উল্লেখযোগ্য ব্যয় করে যা পুরো পৃথিবীর সমষ্টিগত শক্তির ১২.২%।

পরিবেশবান্ধব শক্তিতে রুপান্তর শুধুমাত্র পৃথিবীতে ক্ষতিকর গ্যাসের বিকিরন কমানোর নিশ্চয়তা দেয় না বরং এটি নতুন কর্মসংস্থানও তৈরী করে। গত বছরে দেশটিতে উক্ত ক্ষেত্রে ৩০০০০০ এরও বেশী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয়েছে।

৭। কানাডাঃ দক্ষিন আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত গত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে কিয়োটো প্রটোকলে সাক্ষরিত গ্রুপ থেকে বিদায় নেয়া সত্ত্বেও, কানাডা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অত্যাধুনিক সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রতিযোগিতা করছে। নবায়নযোগ্য শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, কানাডা ৫২০০ মেগাওয়াটের বায়ুশক্তির ক্ষমতায় বিশ্বে নবম বৃহত্তম দেশ যা পুরো পৃথিবীর সমষ্টিগত পরিমানের ২.২%।

৮। দক্ষিন কোরিয়াঃ উক্ত র‌্যাংকিংয়ে আট নম্বর অবস্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। দেশটি রাজধানী সিউল থেকে ৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং ব্যাবসার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে “সংদ আন্তর্জাতিক বানিজ্য জেলা” নামক উচ্চাবিলাসী নগর পরিকল্পনার প্রকল্প স্থাপন করতে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে ৫ বছর “সবুজ বৃদ্ধি” নামক কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সবুজ প্রযুক্তির বানিজ্যকীকরন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

৯। আয়ারল্যান্ডঃ চারদিক সবুজ বায়ুমন্ডলে পরিবেষ্টিত আয়ারল্যান্ড রয়েছে র‌্যাংকিংয়ে নবম নম্বরে। PWC এর গবেষণা মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কার্যকরী সবুজ বিনিয়োগ ২ বছরেও বৃদ্ধে পেয়েছে ২.৩ বিলিয়ন ডলার। অধিকন্তু, আয়ারল্যান্ড তাদের ট্যাক্স সিস্টেমে বনভুমি ধ্বংস ও অবক্ষয় কমিয়ে বিকিরন হ্রাসের প্রকল্পের মাধ্যমে কার্বন কৃতিত্ব অর্জন করেছে।

১০। যুক্তরাজ্যঃ দশম স্থানে অবস্থিত যুক্তরাজ্য অলিম্পিক পার্ক বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্রাজিল এবং পুরো বিশ্বকে সমাধানের অনুপ্রেরনা বাড়িয়ে প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। এছাড়াও দেশটিতে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহী উদ্যোক্তার প্রাচুর্য রয়েছে। এক জরিপ মতে, ৯৯% ব্রিটিশ ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, দেশটিতে সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং ব্যবহার বৃদ্ধি প্রবলভাবে সংঘটিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রেক্ষিতে, দেশটি বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ভুক্ত সেসকল দেশ সমুহে সবুজ প্রযুক্তি একটি বিরাট আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সৌরশক্তির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থার সহায়তায় আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌর বিদ্যুৎ পৌছে যাচ্ছে। তবে এর খরচ এখনো আমাদের দেশে অনেক উচ্চ যা সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে। আরো বৃহত্তর পরিসরে সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে আমরা আমাদের দেশকে সম্ভাব্য দুর্যোগ হতে রক্ষায় সহায়তা করতে পারবো। এর জন্য প্রয়োজন আরো বেশি পরিমানে সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং জনসচেতনতা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics