উদীয়মান তরুণ বিজ্ঞানী সাজিদ আলী

মোহাম্মদ সাজিদ আলী হাওলাদার ফেলোশিপ নিয়ে হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ফিনল্যান্ড) জীববিজ্ঞান বিভাগে ব্যাঙের শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যার (ট্যাক্সেনমি) ওপর পিএইচডি করছেন। এই সুযোগ তাঁকে এনে দিয়েছে যে কাজ, তা তিনি বাংলাদেশে ছাত্র অবস্থায় করেছেন।
তখন সাজিদ সবে কলেজ পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। বয়স মাত্র ২০ বছর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতির বিশাল বিস্তার, এর গভীর ঝোপ-জঙ্গল, জলাশয় সার্বিকভাবে তাঁকে আকৃষ্ট করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রাণীবিদ্যার ছাত্র হিসেবে এখানকার ছোট-বড় জীবজন্তু, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ-মাকড়সাকে অন্তরঙ্গভাবে জানার আগ্রহ তাঁকে উৎসাহী করে তোলে।2013-04-01-20-36-13-5159efbddf1f3-untitled-24
প্রকৃতিকে দেখা ও জানার আগ্রহ সাজিদের বাল্যকাল থেকেই। প্রকৃতিকে দেখা-জানার সাধারণ ইচ্ছা থেকে সাজিদ হয়ে ওঠেন এক প্রকৃতি গবেষক ও বিজ্ঞানী। তরুণ বয়সে প্রথমত সাজিদ পাখি শনাক্তকরণ বা শ্রেণীবিন্যাসের চেষ্টা করেন। প্রাতিষ্ঠানিক উৎসাহ খুব একটা না পেয়ে তিনি একা একা ‘ব্যাঙ শনাক্তকরণ’ কাজে মন দেন। কাজে নেমে তিনি বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ দেশের বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হন। বিশেষ করে, সমকালীন বই-পত্রপত্রিকা, প্রযুক্তি ও পরামর্শক সহকর্মীর অভাব বোধ করেন।
তখন সাজিদ নানা দেশে এ বিষয়ের বিজ্ঞান গবেষকের সন্ধান করতে থাকেন ও নানামুখী সহায়তার সন্ধান পেয়েও যান। কাজ করার একপর্যায়ে একটি নতুন প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পান, এর আগে আন্তর্জাতিক রেকর্ডে অন্য কোনো জীববিজ্ঞানী তা নথিভুক্ত করেননি। সাজিদ এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে ২০০৭ সালে যে মৌলিক বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনা করেন, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞ মহল তাঁর সেই মৌলিক অবদান স্বীকার করে নেয়। সেই মৌলিক রচনা একক নামে প্রকাশিত হয় নিউজিল্যান্ডের ZOOTAXA নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে।
প্রথা অনুযায়ী, নতুন ব্যাঙটির নামকরণ করা হয় zakerava (Fejervarya) asmati sp। এই নামকরণ বিশ্ব ব্যাঙ নমুনা রেকর্ডলিস্টে এক নতুন সংযোজন। এই আবিষ্কারের সূত্র ধরে সাজিদ আরও এগিয়ে যান। তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিতর্কে গণ (জেনাস) Fejervarya থেকে আলাদা করে তাঁর দেওয়া নতুন নাম Zakerava-তে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। প্রজাতির তুলনায় গণ পর্যায়ে সংস্কার করাটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আরও উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, যা শ্রেণীকরণবিদ্যার ভাষায় দাঁড়ায়: zakerava howlader 2011.
এই নামকরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস প্রয়াত জাকের হোসেনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে করা হয়েছে। এ ধরনের নতুন ব্যাঙ শনাক্তকরণে গণ ও প্রজাতির একত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা লাভের ঘটনা বাংলাদেশে কেন, অনেক দেশেই বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এর কপিরাইট সংরক্ষিত রয়েছে।
সাজিদের এই কৃতিত্বে আকৃষ্ট হয়ে ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস, বেলজিয়ামের জীববিজ্ঞানের প্রবীণ অধ্যাপক ফ্রাঙ্কি বসুইট ২০১১ সালে তাঁর সঙ্গে সাজিদকে এমএস করার আমন্ত্রণ জানান। তবে সেখানে তাঁর যাওয়া হয়নি। একই বছরে হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ডের খ্যাতনামা অধ্যাপক ইয়োহা মারিলা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে এমএস বাদ দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে নিয়ে নেন।2013-04-01-18-53-49-5159d7bdd2510-untitled-25
হেলসিংকির কাজেও সাজিদ ব্যতিক্রমী এক পদক্ষেপ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের নিয়ম অনুযায়ী সেই দেশের স্থানীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সেই নিয়ম না মেনে তিনি বাংলাদেশ থেকে ১০০টি ব্যাঙ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা মেনে নেয়। বাংলাদেশি ব্যাঙের ওপর ডিএনএ সিকুয়েন্সিং পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করে এ পর্যন্ত তিনি আরও ছয়টি নতুন প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পেয়েছেন। সাজিদের বর্তমানের মৌলিক গবেষণাপত্রের সংখ্যা এবং তাঁর আট মাসের কাজের পরিধি বিবেচনায় এরই মধ্যে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভের থিসিসের কাজ শেষ করেছেন।
এই ব্যাঙ শনাক্তকরণবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সাজিদ মোলিকুলীয় পর্যায়ে বিবর্তনবাদের পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। এসব কাজের পরিকল্পনায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম ক্যানসারের বায়োডাইভার্সিটি ইনস্টিটিউট, পর্তুগালের লিসনো বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির ন্যাচারাল মিউজিয়ামসহ পৃথিবীর অনেক দেশের বিজ্ঞানী মহলের সহায়তা পেয়েছেন।
সাজিদ আলীর জন্ম ঢাকায়। ১৯৮৫ সালে। তাঁর স্কুল ও কলেজজীবন কাটে ঢাকায়। বাবা সরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। তাঁরা দুই ভাই, এক বোন। সাজিদ সবার ছোট। তিনি বর্তমানে গবেষণাকাজের সূত্রে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
মোহাম্মদ সাজিদ আলী হাওলাদারের মাত্র ২৭ বছর বয়সের সফলতা আগামী দিনের তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

রেজাউর রহমান

লেখক: পরমাণুবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানলেখক

আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: ab@prothom-alo.info

সূত্রঃ প্রথম আলো, ০২,০৪,২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics